কলকাতায় এসে, ‘গুরু’ অনিলেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে নোবেল তুলে দিলেন পাকিস্তানের আবদুস সালাম

কথায় বলে, একজন প্রকৃত গুরুই তাঁর শিষ্যের সেরাটাকে সামনে তুলে আনতে পারেন। তাঁকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, দেখাতে পারেন নতুন দিশা। বিশ্বের তাবড় তাবড় গবেষক, বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয় না। আর তাই সেই শিক্ষককে যোগ্য সম্মান দিতে, ছাত্র কাঁটাতারের পরোয়া না করেও তাঁর সামনে চলে আসেন। ঠিক এইরকমই ঘটনা ঘটেছিল লাহোরের সনাতন ধর্ম কলেজের অঙ্কের প্রাক্তন প্রফেসর অনিলেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আর ছাত্র? তিনি পাকিস্তানের প্রথম নোবেল লরিয়েট, পদার্থবিদ বিজ্ঞানী ডঃ আবদুস সালাম।

এই গল্পটি শুরু হয়েছিল চল্লিশের দশক থেকে। তরুণ সালাম তখন লাহোরের সনাতন ধর্ম কলেজের ছাত্র। অত্যন্ত মেধাবী, কিন্তু সেই সঙ্গে অসম্ভব খামখেয়ালি। সেই সময় কলেজে অঙ্কের প্রফেসর ছিলেন অনিলেন্দ্রবাবু। এই খামখেয়ালি, মেধাবী ছাত্রটিকে এক সময় অঙ্কের জাদুতে বেঁধে ফেললেন তিনি। অঙ্কের প্রতি আকর্ষণ আরও তীব্র হল। প্রফেসরের অন্যতম প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলেন আবদুস সালাম।

তারপর, কেটে গেছে বহু বছর। ঘটে গেছে দেশভাগ। লাহোর ছেড়ে অনিলেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় চলে এলন কলকাতায়। আর তাঁর সালাম? তিনি তখন বিদেশে নিজের ডক্টরেট শেষ করে পদার্থবিদ্যার গবেষণায় মজেছেন। এমন সময়, ১৯৭৯ সালে এল সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত। ‘ইলেক্ট্রোউইক ইউনিফিকেশন থিয়োরি’ নিয়ে গবেষণার জন্য শেলডন গ্ল্যাসগো এবং স্টিভেন ওয়েনবার্গের সঙ্গে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হন ডঃ আবদুস সালাম। পাকিস্তান পেল তাঁদের প্রথম নোবেলজয়ীকে। বিশ্ব পেল এক কিংবদন্তি পদার্থবিদকে।

সেই সময় দক্ষিণ কলকাতায় বসে, অসুস্থ অনিলেন্দ্রবাবু কি পেয়েছিলেন প্রিয় ছাত্রের এই গবেষণার খবর? সেটা জানা যায়নি। তবে গল্প এখানেই শেষ নয়। আবদুস সালাম কিছুতেই ভুলতে পারেননি তাঁর এই বাঙালি শিক্ষকের কথা। এমনকি, নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়েও স্মরণ করেছিলেন মাস্টারমশাইকে। ১৯৭৯ সালে নোবেল জয়ের পর তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আহ্বানে ভারতে আসেন তিনি। আর এসেই খোঁজ করতে লাগলেন অনিলেন্দ্রবাবুর। অবশেষে, দেখা হল। ১৯৮১ সালে যখন কলকাতায় আসেন, তখন প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করেন আবদুস সালাম। প্রণাম করার পর বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ অনিলেন্দ্রবাবুর হাতে তুলে দেন গুরুদক্ষিণা, নোবেল পুরস্কার। জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি অর্পণ করলেন শিক্ষককে।

আরও পড়ুন
নবদ্বীপে তখন নিমাই পণ্ডিতের জয়জয়কার, বিদায়ের আগে জড়িয়ে ধরলেন প্রত্যেক ছাত্রকে

প্রতিবার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পেছনে হয়ত থেকে যায় এরকমই কত কাহিনি। গুরু-শিষ্যের পুনর্মিলন হওয়ার পরের বছরই চলে যান অনিলেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। তারপর ১৯৯৬ সালে চলে যান আবদুস সালামও। কিন্তু থেকে গেছে এই কাহিনিগুলো। থেকে গেছে ছাত্র-শিক্ষকের এই সম্পর্ক, এই মূল্যবোধগুলো। থেকে গেছে তাঁদের গবেষণা।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ছাত্রের থিসিস থেকে 'নকল করে' বই লিখেছেন ডঃ রাধাকৃষ্ণন? জল গড়িয়েছিল আদালতেও