তামিলনাড়ুর রামেশ্বরের দরিদ্র্য মুসলমান পরিবারের ছেলেটি ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখত সে একদিন আকাশে উড়বে। সমুদ্রের তীরে বসে অবিরাম তাকিয়ে থাকত আকাশের দিকে। কীভাবে ডানায় ভর দিয়ে উড়ে চলে অসংখ্য পাখি। মানুষের ডানা নেই। কিন্তু বিমানে ভর দিয়ে তো সেও উড়ে যেতে পারে। স্বপ্ন দেখার শুরু সেদিন থেকেই। কিন্তু সেই স্বপ্নই যদি কোনোদিন ভেঙে যায়? তাহলে তো অবসাদ গ্রাস করবেই।
সময়টা ১৯৫৮ সালের দিকে। মাদ্রাজ ইন্সটিউটিউট অফ টেকনোলজি থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেছেন এ. পি. জে. আব্দুল কালাম। বিষয় অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। পদার্থবিজ্ঞান ছেড়ে এই বিষয় নিয়ে পড়ার একমাত্র উদ্দেশ্য বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়া। সেই তো তাঁর ছোটোবেলার স্বপ্ন। আর সুযোগও এসে গেল হাতে হাতে। একসঙ্গে দুটি সংস্থা ক্যাম্পাসিং-এর উদ্দেশ্যে হাজির হয়েছে। একটি বিমানবাহিনী, আর অন্যটি কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রালয়ের অধীনস্থ ডিরেক্টরেট অফ টেকনিক্যাল ডেভালাপমেন্ট অ্যান্ড প্রোডাকশন। দুটোতেই আবেদন করলেও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রথমটাই। অর্থাৎ বিমানবাহিনী। যোগ্যতার কোনো খামতি তাঁর ছিল না। কিন্তু বিমানবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন অন্য একটা জিনিস। স্মার্টনেস এবং শারীরিক ক্ষমতা। আর এখানেই পিছিয়ে পড়লেন কালাম।
তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেছে নেওয়া হল ৮জন পাইলটকে। কিন্তু কালাম ছিলেন তালিকায় ৯ম স্থানে। অবশ্য ডিটিডি-অ্যান্ড-পি-তে সফলভাবেই স্থান পেলেন তিনি। কিন্তু ছেলেবেলার সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল এক লহমায়। আর এমন অবস্থায় আর সকলের যা হয় তাই হল আব্দুল কালামের। গভীর হতাশা গ্রাস করল তাঁকে। আর এমন অবস্থায় ভগ্ন হৃদয়ে তিনি পাড়ি দিলেন হৃষীকেশ। মুসলমান পরিবারের সন্তান হলেও তাঁর পরিবারে ধর্মান্ধতা কোনোদিনই ছিল না। বরং পৃথিবীর সকল ধর্মের মধ্যেই যা কিছু কল্যাণকর, তাকেই মুক্ত মনে গ্রহণ করতে শিখেছিলেন তিনি। কোরানের মতোই তিনি মুখস্ত বলতে পারতেন গীতা। এই কারণেই হয়তো হৃষীকেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেখানেই সাক্ষাৎ হল স্বামী শিবানন্দের সঙ্গে। আর তিনিই সেই হতাশ যুবককে আবার ফিরিয়ে আনলেন সমাজের মূল স্রোতে।
স্বামী শিবানন্দের কাছেই কালাম শিখেছিলেন জীবনে যা কিছুই আসে, তাকেই ঈশ্বরের দান বলে মাথায় ঠেকিয়ে নিতে হয়। তাই হৃষীকেশ থেকে কালাম সোজা পৌঁছে গেলেন দিল্লিতে। সেখানে যোগ দিলেন ডিটিডি-অ্যান্ড-পি-তে। রামেশ্বরের দরিদ্র্য মৎস্যজীবীর সন্তান আব্দুল কালাম ছোটো থেকেই নানা দুঃখকষ্টের মধ্যে বড়ো হয়েছেন। পড়াশুনো চালানোর জন্য ছোটো থেকেই সংবাদপত্র বিক্রি করতে বেরোতেন তিনি। অথচ এই দারিদ্র্যের মধ্যেও কখনও অধ্যাবসায়ের ঘাটতি হয়নি। চাকরিতে যোগ দিয়ে সেই অর্থসঙ্কট শেষ হয়। মন দিয়ে কাজ করতে থাকেন তিনি। কিন্তু শৈশবের স্বপ্ন তখনও পিছু ছাড়েনি। আর এমন সময়েই এল আরেক সুযোগ। বছর তিনেক কাজ করার পরেই তৈরি হল স্বদেশি হোভারক্রাফট নির্মাণের সংস্থা অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট। হোভারক্রাফটের নকশা ও বাস্তবায়নের জন্য গঠন করা দলটির দায়িত্ব দেয়া হয় আব্দুল কালামকে। অথচ দলের কারোরই নেই কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা। নেই কোনো উন্নত যন্ত্রপাতি। অন্য সংস্থার ইঞ্জিনিয়াররা তখন টিটকিরি দিতে শুরু করল মফঃস্বলের ছেলেটিকে। আর আব্দুল কালামের কাছে তাই এই প্রকল্প হয়ে উঠল একটা চ্যালেঞ্জ। পুরো কাজ শেষ করতে সময় দেওয়া হয়েছিল ৩ বছর। কিন্তু কালাম মাত্র ৬ মাসেই তৈরি করে ফেললেন দেশের প্রথম হোভারক্রাফট। নাম দেওয়া হল নন্দী।
নন্দীর সফল উড্ডয়ন যেন প্রথম সাফল্যের স্বাদ এনে দিল আব্দুল কালামকে। ছাত্রাবস্থার একেকটি রেজাল্ট তখন আর মনেই পড়ে না। এর পর ডাক পেলেন টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ থেকে। শুরু করলেন রকেট উৎক্ষেপণের কাজ। এই সময়েই ১৯৬৩ সালে তিনি গেলেন আমেরিকা। উদ্দেশ্য নাসার উন্নত প্রযুক্তি পর্যবেক্ষণ করা। ফিরে এলেন ১৯৬৫ সালে। অবস্য জীবনে সেই একবারই বিদেশে গিয়েছিলেন তিনি। দেশের মাটি ছেড়ে যেতে তাঁর কোনোদিনই মন সায় দিত না।
পাইলট হওয়া হয়নি। কিন্তু আব্দুল কালাম হয়ে উঠলেন ভারতের মিসাইল ম্যান। সালটা ১৯৯৮। ভারতের প্রথম পরমাণু পরীক্ষা পোখরানের সম্পূর্ণ পরিকল্পনাই ছিল তাঁর। যে ছেলে বঙ্গোপসাগরের ধারে বসে বসে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখত, দুই দশক ধরে সেই সমুদ্রের তীরে কত না ক্ষেপনাস্ত্র উৎক্ষেপম করেছেন তিনি। অগ্নি আর পৃথিবীর কথা কে না জানেন!
আরও পড়ুন
যুদ্ধক্ষেত্রেও হারায়নি মানবিকতা, আমেরিকার বোমারু বিমানকে ‘জীবনদান’ জার্মান পাইলটের
সারা জীবনে অবশ্য কম সম্মান পাননি তিনি। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, ভারতরত্ন; প্রাপ্তির ঝুলি একেবারেই ভর্তি। এর মধ্যেই আবার এল আরেক দায়িত্ব। ২০০২ সালে আব্দুল কালাম শপথ নিলেন দেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে। তাঁর ৫ বছরের মেয়াদের সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই মোটামুটি পরিচিত। এমন দিলখোলা রাষ্ট্রপতি এদেশে আর কেউ ছিলেন কিনা সন্দেহ। তাঁর সময়কালে রাষ্ট্রপতি ভবন যেন ছিল এক উন্মুক্ত প্রাসাদ। বিশেষ করে শিশুদের জন্য সে দরজা কখনোই বন্ধ থাকত না। আর তাঁর কথা বললে তাঁর কর্মস্পৃহার কথা বলতেই হয়। আজ থেকে ঠিক ৫ বছর আগে ২৭ জুলাই, ২০১৫ অসংখ্য কাজ অসম্পূর্ণ রেখে চলে গেলেন আব্দুল কালাম। এমন একটা মানুষের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হবে, এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষটির জীবনের সাধনার কথা মাথায় রেখেই কোনো কাজে ছুটি দেওয়া হয়নি। বরং তাঁর মৃত্যুতে সমস্ত দেশবাসী যেন খানিকটা বেশি কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দেশবাসীকে যে তিনি শিখিয়েছিলেন, চোখ বুজে নয়, স্বপ্ন দেখত হয় চোখ খোলা রেখে। কাজের মধ্যেই তো সমস্ত সার্থকতা।
ঋণঃ My Journey: Transforming Dreams into Actions, A.P.J. Abdul Kalam
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সুদূর রাশিয়া থেকে পড়ুয়াদের ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী দেব, ব্যবস্থা করলেন বিমানের