চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে আবর্জনা। তারই মাঝে একটা জরাজীর্ণ বাড়ি। আবর্জনার দুর্গন্ধ ঘিরে ধরেছে তাকে। টিনের ছাদটিও ভেঙে পড়েছে জায়গায় জায়গায়। সব মিলিয়ে, আর পাঁচটা পুরনো, ভেঙে পড়া বাড়ির থেকে আপাতভাবে আলাদা কিছুই নয়। কিন্তু বাংলাদেশের কুমিল্লার এই বাড়িটি অন্যান্যদের মতো তো নয়! এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত ইতিহাস! জড়িয়ে আছেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে যিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি। এই বাড়িতেই কেটেছে তাঁর জীবন। আর আজ, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে জঞ্জালের জায়গা।
প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি দুই বাংলা মেতে ওঠে ভাষার উদযাপনে। বাংলা ভাষা নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, তারই কথা স্মরণ করি আমরা। এই যে এত কাণ্ড ভাষাদিবসকে নিয়ে, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত না থাকলে সেটার সূচনাই হত না। একুশের প্রতিটা শিরায় মিশে আছেন তিনি।
আরও পড়ুন
বাংলা ভাষাকে উন্মুক্ত করেছেন ‘ডিজিটাল বিশ্বকর্মা’ মেহেদী হাসান
একটু পিছনে ফেরা যাক। ১৯৪৭ সাল। দ্বিজাতি-তত্ত্ব মেনে অখণ্ড ভারতকে খণ্ডিত করা হবে। একটি অংশ ভারত, অপরটি পাকিস্তান। এদিকে পাকিস্তানেরও দুটি ভাগ- পশ্চিম আর পূর্ব। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, করাচিতে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন। সেখানে প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল, উর্দুর সঙ্গে শুধু ইংরেজিকে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে এর বিরোধিতা করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পূর্ব পাকিস্তানও যে এর সঙ্গে আছে। তাদের মাতৃভাষা কোথায় যাবে তাহলে? উর্দু, ইংরেজির সঙ্গে যুক্ত হোক বাংলাও। একই দাবি ২৫ ফেব্রুয়ারিও জানান তিনি। তৈরি করেন সংশোধনী প্রস্তাব।
সেই প্রথম বাংলাকে মর্যাদা দেওয়ার প্রসঙ্গটি উঠে এল। কেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা তাঁদের মাতৃভাষা বর্জন করবে? এটা তো অপমান! কিন্তু পাকিস্তান সরকার নাছোড়বান্দা। ১৯৫০ সালে তাঁরা জানালেন, আরবি হরফে বাংলা লেখা যাবে। আবারও আঘাত! বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে এর ঠিক দুই বছর পর, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একদল তরুণ আন্দোলন করেন। মিছিল করেন। বাকিটা ইতিহাস। প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন ধীরেন্দ্রনাথও।
আরও পড়ুন
মাতৃভাষা বাঁচিয়ে রাখতে লড়ছেন সাপা জনগোষ্ঠীর মানুষরা
সারাজীবন কুমিল্লায় থেকেছেন মানুষটি। জন্মও এখানে। মাটির প্রতি টান ছিল বরাবরের। যে বাড়িটিকে নিয়ে শুরু হয়েছিল এই প্রতিবেদন, সেটিই ছিল তাঁর ঠিকানা। এখান থেকেই ১৯৭১-এর ২৯ মার্চ তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পাক সেনারা। ব্যস, সেই শেষ প্রস্থান। সেনাদের হাতেই শহিদ হন তিনি। তাঁর মরদেহও কেউ দেখেনি শেষ পর্যন্ত। তারপর থেকে বাড়িটাও ছন্নছাড়া।
পরতে পরতে লেগে আছে ইতিহাস। কিন্তু দেখে বোঝার এতটুকুও উপায় নেই। যত দিন যাচ্ছে, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটির অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এখনও তাঁর ব্যবহৃত খাট, বিছানা, বালিশ রয়েছে ভেতরে। রিকশার গ্যারাজ হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এটি। ভেতরের বেশ কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। জল, জঙ্গল, আবর্জনা জমে রয়েছে এখানে সেখানে। দীর্ঘদিন ধরে মিউজিয়াম বানানোর দাবি জানানো হচ্ছে। ২০১০ সালে সেই যাদুঘর তৈরির আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল সরকারের তরফ থেকে। আজ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি বলে জানান বাসিন্দারা। বাড়ির সামনে থাকা সাইনবোর্ডও ভেঙে গেছে। সব মিলিয়ে আবারও ইতিহাসের ধ্বংসের সাক্ষী থাকছি আমরা। বলা ভালো, আমরাই সেটা সম্ভব করছি। উদ্যোগ নিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটিকে সংরক্ষণ করা যেত না? বাড়ির বর্তমান মালিক যারা, তাদেরও কি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না এটা?