সময়টা উনবিংশ শতকের শেষের দিক। কলকাতায় ‘নারী স্বাধীনতা’ শব্দটা একটু একটু করে উঠছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় তো আছেনই, সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন আরও বেশ কিছু জন। তথাকথিত রক্ষণশীল সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে যে করেই হোক। এই চালচিত্রের মধ্যেই বেড়ে উঠছিলেন এক কিশোরী। ছোটো থেকে সমাজের অন্য মেয়েদের মতো বদ্ধ পরিবেশ পাননি তিনি। বরং এক মুক্ত হাওয়ার মধ্যেই তাঁর বেড়ে ওঠা। বাবা দুর্গামোহন দাসও তাই-ই চেয়েছিলেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষা শেষে কিশোরীর স্থির দৃষ্টি ছিল সেই সাদা গাউন, আর স্টেথোস্কোপের দিকে। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি আসার খানিক আগের ঘটনা। কিন্তু কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে তো মেয়েরা ডাক্তারি পড়তে পারবে না! তখনও সেই বেড়া ভাঙেনি। বরিশালের অবলা দাশ কোনোকিছুর পরোয়া করলেন না। বাবাকে বুঝিয়ে সোজা চলে গেলেন মাদ্রাজ। সেখান থেকে শুরু হল একটা যাত্রার। অবলা দাস পরবর্তীকালে হয়ে উঠলেন লেডি অবলা বসু। কিন্তু লড়াই? সেটা একই থাকল…
একদিক থেকে দেখতে গেলে অবলা বসুর পিতৃ-পরিবার যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। একটা সময় বোন সরলা রায়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল। আর পারিবারিক সূত্রে চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন তাঁর দাদা। সেসব এখন থাক। যদি তথ্যের হিসেব ধরা হয়, তবে অবলাই বাঙালি মেয়েদের মধ্যে প্রথম ডাক্তারি পড়তে যান। তাও আবার রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে। কিন্তু বাংলার পরিবেশ এক, আর মাদ্রাজের আরেক। সেখানে মেয়েদের জন্য হোস্টেল ছিল না। বারবার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ায় পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই দুই বছর ডাক্তারি পড়ার পর ফিরে আসতে বাধ্য হন অবলা।
সারাজীবন নারীদের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। আর বিজ্ঞান সাধনার পথ থেকে তো কোনদিনই সরেননি। পাশে ছিলেন আরেক কিংবদন্তিসম বিজ্ঞানী, জগদীশচন্দ্র বসু। স্বামীর বিজ্ঞানসাধনায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, তার জন্য যথাসর্বস্ব চেষ্টা করে গেছেন। অনেক সময় নিজেও সাহায্য করতেন নানা কাজে। স্ত্রীর এমন মেধা এবং পারদর্শিতাকে সম্মান করতেন জগদীশচন্দ্রও। তাই পরবর্তীকালে দেশে-বিদেশে যতগুলি ছবি দেখা যায়, প্রায় সব জায়গাতেই জগদীশের সঙ্গে অবলা উপস্থিত আছেন।
একটা সময় প্রবল আর্থিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন দুজন। জগদীশচন্দ্র তখন দেশীয় অধ্যাপকদের সমবেতনের দাবির জন্য লড়ছেন। সেজন্য মাইনেও পাচ্ছেন না। একটু একটু করে অবস্থা যখন ফিরল, তখন আরেকটা স্বপ্ন বেড়ে উঠতে শুরু করল। এমন একটা জায়গা তৈরি হোক, যেখানে যোগ্য ছাত্ররা এসে নিজেদের মতো গবেষণা করতে পারবে। বিজ্ঞানের উপাসনা হবে সেখানে। শুরু হল ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ তৈরির কাজ। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের পাশে ওই বাড়িটার ভেতরে ঢুকলে আজও চোখে ধাঁধা লেগে যায়। নিজেদের বাড়িকে তখনকার আমলে কী ভাবে একটা উন্নত মানের গবেষণা কেন্দ্র বানিয়েছিলেন! শুধু বিজ্ঞান তো নয়, দুজনের সংগ্রহ করা একের পর এক শিল্পের নিদর্শনও সেই দর্শনীয় সামগ্রীর মধ্যে পড়ে।
বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে চোখে পড়বে একটি পার্ক। তার পাশেই লাল রঙের একটি বাড়ি। আদতে সেটি একটি স্কুল, নাম ‘ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়’। অবলা বসুর হাত ধরেই স্কুলটি নতুন রূপ পায়। তবে অবলার আসল কাজটি হল নারীচেতনা ও নারীশিক্ষায় অবদান। সেই সময়ের সমাজের চিত্রটা তখনও বদল হয়নি। ভগিনী নিবেদিতা ও অন্যান্যদের হাত ধরে নারীশিক্ষায় একটা বদল আসে। সেটাকেই ত্বরান্বিত করেন অবলা বসু। ১৯১৯ সালে তৈরি করেন ‘নারী শিক্ষা সমিতি’। শুধু শহরাঞ্চলে নয়, বাংলার প্রতিটা গ্রামে যাতে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ে তা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। আচার্য জগদীশ বসু মারা গেলে তাঁর সঞ্চিত টাকা দিয়ে সিস্টার নিবেদিতা উইমেন্স এডুকেশন ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। ছোটো ছোটো পদক্ষেপ, কিন্তু প্রতিটার লক্ষ্য একটাই- নারী ও শিশুদের সার্বিক উন্নয়ন।
গল্প শুরু হয়েছিল ডাক্তারি দিয়ে। সেখান থেকে বিয়ে, সংসার, বিজ্ঞানচর্চা, নারীশিক্ষার প্রচার সবই হল। অবলার আরও একটি দিকের কথা না বললেই নয়। ঘুরতে যেতে বললে আমরা এক পায়ে রাজি। অনেকেরই পায়ের নিচে সর্ষে। তাঁদেরই কয়েকজন ফিরে এসে সেই বর্ণনাই নিজের মতো করে লিখে যান। হয়ত আরও একবার ফিরে দেখতে চান সেই যাত্রাটিকে। বাংলায় ভ্রমণ কাহিনি- এই ঘরানাটিতেও পটু হাতে ঘুরে বেরিয়েছেন অবলা। জগদীশচন্দ্রের লেখার নমুনা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। কিন্তু অবলা বসুর লেখাও সেই সময়ের ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকাতে ছাপা হয়। তাঁর কাহিনিগুলোকে জড়ো করে বইও বেরিয়েছে। কিন্তু শেষ যাত্রাটির গল্প লিখে যাওয়ার আর সময় হয়নি। তাঁর কাছে আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা সবার আগে। “নারীর শিক্ষাকে যেন ভালো পাত্র পাওয়ার উপলক্ষ হিসাবে ভাবা না হয়”- শেষ দিন পর্যন্ত এমন কথাই বলে গেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
‘বিপ্লবকে অভিনন্দন’, মহিলাদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত আইনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে উদ্বেল সুদান
তথ্যসূত্র-
১) রোর বাংলা, ‘অবলা বসু : স্বামীর কীর্তিতে চাপা পড়া এক মহিয়সী মহিলার গল্প’
২) এই সময়, ‘অবলা বসু, অনন্য এক বাঙালি নারীকে চিনুন’
আরও পড়ুন
ভারতের প্রথম মহিলা কমব্যাট ট্রেনার সীমা, হাত পাকিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালনাতেও
৩) ইচ্ছামতী, ‘অবলা বসুর কথা’
Powered by Froala Editor