১৯৪২ সাল। দেশজুড়ে চলছে আগস্ট আন্দোলনের উন্মাদনা। গান্ধীজির ডাকে স্বাধীনতার জন্য ফের উত্তাল হয়েছে দেশবাসী। একই সঙ্গে রয়েছে ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচার। ‘ভারত ছাড়ো’ কর্মসূচি ঘোষণার দিনই গ্রেপ্তার করা হয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের। পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে সারা দেশে কয়েক হাজার লোককে জেলবন্দি করা হয়। ১২ আগস্ট, রাত দুটো নাগাদ পুলিশের ভারি বুটের শব্দে সজাগ হয়ে উঠল প্রয়াগরাজের একটি বাড়ি। গতকালই ছাত্রদের মিছিলে নৃশংসভাবে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। রক্তে ভেসে গেছে শহরের রাস্তা। সেই বিভীষিকার মধ্যেও আহতদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত (Vijaya Lakshmi Pandit)। সারা দিনের পরিশ্রমের শেষে ক্লান্ত শরীর যখন বিশ্রাম চাইছে, তখনই উপস্থিত হল পুলিশ বাহিনী।
গ্রেপ্তার যে হতে হবে, সেটা ভালো মতোই জানতেন তিনি। কিন্তু একজন নিরস্ত্র মহিলাকে গ্রেপ্তার করার জন্য গভীর রাতে অসংখ্য পুলিশ নিয়ে খোদ ম্যাজিস্ট্রেটের আগমন বিরক্তিজনক তো বটেই। তার মধ্যে চলছে খানাতল্লাশির ব্যবস্থা। বাড়িতে তখন প্রায় সকলেই মহিলা। ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi) সেদিন সকালেই এসেছেন মুম্বই থেকে। আর ছোটো মেয়ে রিতা ঘুম চোখে বোঝার চেষ্টা করছে সার্বিক পরিস্থিতি। বিদায়কালে শুধু একটাই কথা বলল কিশোরী কন্যা, “তুমি যখন জেলের ভেতরে থাকবে, তখন আমরা বাইরে ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াই চালাব।”
এই নিয়ে তৃতীয়বার জেলবন্দি হলেন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। ১৯৩৭ সালে যখন গ্রেপ্তার হন, সেখান থেকেই যেন ফের শুরু হল জেলের জীবন। সে বছরই তিনি স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের প্রথম মহিলা হিসেবে যুক্তপ্রদেশের প্রাদেশিক আইনসভায় সদস্য হয়েছিলেন। জনস্বাস্থ্য দপ্তরের মন্ত্রীত্বের কার্যভার সামলেছেন। মতিলাল নেহরুর কন্যা ও জওহরলাল নেহরুর বোন, এই পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বক্ষেত্রে। প্রকৃত নাম অবশ্য ছিল স্বরূপ কুমারী নেহরু। ১৯২১ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন রঞ্জিত সীতারাম পণ্ডিতের সঙ্গে।
১৯৪২-এ যখন বিজয়লক্ষ্মী জেলবন্দি হন, রঞ্জিত তখন গুরুতর অসুস্থ। মুম্বই থেকে তাঁকে প্রথমে এখানে আসার অনুমতি দেয়নি ব্রিটিশ সরকার। অবশেষে ১০ অক্টোবর জেলেই দেখা হল দুজনের। একই জেলের দুটি প্রান্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলেন দুজনে। কিন্তু রিতা কেমন আছে? সদ্য তেরোয় পড়ল সে। এই নিয়ে তৃতীয়বার তার জন্মদিনে উপস্থিত থাকতে পারলেন না বিজয়লক্ষ্মী। বাইরের কারোর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিতে নারাজ জেল কর্তৃপক্ষ। প্রতিবার আবেদন করেন আর অপেক্ষা করে থাকেন, এবার হয়তো দেখা মিলবে তার সঙ্গে। মাসের পর মাস কেটে গেল। মাঝেমধ্যেই উড়ো খবর আসে যে, অনুমতি মিলেছে। কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারেন সব মিথ্যা, সব সাজানো। যেন জেল কর্তৃপক্ষ একটা নাটক দেখছে মা-মেয়ের দূরত্ব নিয়ে।
আরও পড়ুন
জাপানি শিশুদের অনুরোধ, শুভেচ্ছাসহ ‘ইন্দিরা’কে পাঠালেন নেহরু
১৪ নভেম্বর। সেদিন জওহরলাল নেহরুরও জন্মদিন। রঞ্জিতের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মিলেছে। এদিকে সকালেই খবর পেলেন, রিতা একটি বিশেষ দরকারে আসছে। হয়তো বাইরে দিয়েই দেখা হবে শুধু। একবার কি কাছ থেকে দেখা যায় না? আবারও আবেদন করতে হবে সুপারিনটেনডেন্টকে। বেশ, তাও করতে রাজি তিনি। কিন্তু উলটো দিক জবাব এল, ‘না’। মানে, পুরোটাই ছিল যেন মানসিকভাবে হেনস্থা করার একটা প্রক্রিয়া। দুঃখে-কষ্টে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
আরও পড়ুন
স্বাধীন ভারতে দরকার শিল্পোন্নয়ন, নেহরুর উদ্যোগেই শুরু রয়্যাল এনফিল্ডের পথ চলা
সেই সময় রঞ্জিতের আগমন কিছুটা শক্তি দিল তাঁকে। সমস্ত ঘটনা শুনে জ্বলে উঠলেন রঞ্জিত। শেষ পর্যন্ত কিনা ইংরেজের ঘৃণ্য চক্রান্তের কাছে মাথা নত করতে চলেছেন বিজয়লক্ষ্মী? কারোর কাছে অনুগ্রহ চাইতে হবে, এত দুর্বল তো তাঁরা নন। “তার চেয়ে তুমি অনেক বড়ো। আমাদের এই সংগ্রামে কোনো দুর্বলতা বা অনুগ্রহ ভিক্ষার স্থান নেই। নিজেকে শক্ত কর।” আরো অনেক কথাই হয়তো বলেছিলেন তিনি। সবটা অনুধাবন করতে পারেননি। কিন্তু ক্ষণিকের আবেগে যেভাবে ‘দুর্বল’ হয়ে পড়েছিলেন তিনি, তা ভেবে লজ্জাই হল বিজয়লক্ষ্মীর। না, দেখা হয়নি তখন রীতার সঙ্গে। জেলে থাকাকালীন আর কোনোদিন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদনের পথ গ্রহণ করেননি।
আর যিনি ‘শক্ত’ থাকার কথা বলেছিলেন, তিনি মৃত্যুবরণ করলেন ১৯৪৪ সালে। তার আগের বছরেই বিজয়লক্ষ্মী মুক্তি পেয়েছেন জেল থেকে। শুরু হল নতুন জীবন। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, মেক্সিকো, স্পেনে রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬১ সালে নিযুক্ত হন ইংল্যান্ডের ভারতীয় হাই কমিশনার পদে। ১৯৫৩ সালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভার প্রথম মহিলা সভাপতি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে বিরোধিতা করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর শাসনব্যবস্থার। দূরত্ব বাড়ে নেহরু পরিবারের দুই সদস্যার মধ্যে। ১৯৯০ সালের ১ ডিসেম্বর প্রয়াণ ঘটে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের। স্বাধীনতার দুই প্রান্তের রাজনীতির এক বিরাট অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। দেশের পালাবদলের বিভিন্ন পর্বের ঘনিষ্ঠ সাক্ষী। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও। তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে ভারতীয় রাজনীতির এক বিরাট যুগের।
ঋণস্বীকার : রুদ্ধকারার দিনগুলি, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত
Powered by Froala Editor