'আঠা'গাছে তোতা পাখি

ছোটবেলায় বলতাম গাছেরাও দুধ দেয়। মনসা গাছের কথা বলছি। এই নামেই তাকে প্রথম চেনা। বাড়ির ছাদে সাপের ফণার মতো দেখতে কণ্টকাকীর্ণ এই গাছ ছিল। নাম ফণিমনসা। পাতা ছিঁড়লে সাদা দুধের মতো টসটসে কষ টপটপ করে পড়ত। এটাই ছিল আমাদের কাছে গাছের দুধ। ঘুড়ি ছিঁড়ে গেলে জোড়া তাপ্পি লাগাতে এর আঠা ব্যবহার করতাম প্রায়ই। পরে জেনেছি, গাছটির আঠা থেকে তৈরি তেল অতিউত্তম ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কবিরাজি চিকিৎসা শাস্ত্রেও গাছটির বিরাট কদর। ফণিমনসা গাছের যতই জটিল সর্বস্ব বৈজ্ঞানিক নাম থাকুক না কেন, আমাদের কাছে হয়ে উঠেছিল ‘আঠাগাছ’। মজায় বলতাম, আঠাগাছে তোতা পাখি। প্লিজ, দোষ নেবেন না যোগীন্দ্রনাথ। কথা বলার ছলেই এই বিশেষণ। ফণিমনসার মতো ক্যাকটাস জাতীয় আরেকটি গাছ বাজবরণ। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আঞ্চলিক ভাষায় যা বাজবরন্ড। এর আঠা গরম করে পা মচকে গেলে মালিশ করলে আরাম মেলে। ঘুড়ি তাপ্পি দেওয়ার কথা যখন এল, বলতেই হয় আরও কিছু স্মৃতিমেদুর কথা। ঘুড়ি জুড়তে ঘরে রান্না করা সাদা ভাতেরও জুড়ি মেলা ভার। রান্না করতে গিয়ে ভাত একটু বেশি গলে গেলে তো কথাই নেই।

আপনারা নিশ্চয়ই স্টিকি রাইসের (Sticky Rice) নাম শুনেছেন। যাকে বলে আঠালো ধান। খুবই পরিবেশবান্ধব। আমরা এই স্টিকি রাইসকে বলতাম আঠা-ভাত। ভাতের এই আঠা এতটাই জোরদার যে, উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় দোতারার ছাউনি আটকানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। এমনকী তবলা তৈরিতেও ভাতের আঠার বিকল্প নেই। তবলা তৈরির প্রসঙ্গ উঠতেই মনে পড়ল দেশি গাবের কথা। গাবের ফল থেকে ট্যানা জাতীয় আঠা প্রস্তুত হয়। গাবের আঠাও তবলায় উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়াও এই আঠা জালে লাগানো বা নৌকায় মাখানো হয়। প্রচণ্ড মজবুত এই আঠা জলেও থাকে তাজা। কাপড়ে কালো রং করতেও এর বিকল্প নেই। বহুমূত্র, একজিমা, চর্মরোগ, আমাশয় জাতীয় রোগে কার্যকর ভেষজ এই গাব। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’তে গাছটির ভেষজ প্রয়োগের কথা বর্ণনা করেছেন। যদিও এটা আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ নয়।

আশা করি এতক্ষণে বোঝাতে পেরেছি, ‘আঠাগাছ’ একটি ‘কনসেপ্ট’ এবং ‘সাবজেক্ট’ হল গাছের আঠা। আট হাজার বছর আগেও মানুষ প্রাকৃতিক আঠা ব্যবহার করত। মিশরীয় রাজা তুতানখামেনের কফিনে আঠা ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এই ব্যবহারের শুরুটা যে কোথায়, তা খুঁজতে বোধহয় দশদিনের প্যানেল বসালেও উদ্ধার হবে না। তাই তথ্য না কচলে ফিরি নিজের অভিজ্ঞতায়। স্নাতক স্তরের বাংলা পড়তে যেতাম দিদির (পূর্বা মুখোপাধ্যায়) বাড়ি। বছর কুড়ি আগের কোনও একদিন দিদিকে দেখেছিলাম, তাঁর বাবার ‘বিদগ্ধ’ পত্রিকায় জলে গোলা আটা জ্বাল দিয়ে আঠা বানিয়ে ভাঁজ করা কাগজের এক প্রান্তে এনভেলাপের মতো আটকাচ্ছে। গঁদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয় এই আঠা। হুঁ, আটা গোলা আঠায় মাঝেমাঝে একটু তুঁতে মেশানো হত। তুঁতে দিলে পোকার উৎপাত ঠেকানো যেত। এই টোটকা তো আম-গেরস্থের বেশিরভাগ মা-বোনেরাও জানতেন একসময়। আমরা বইয়ের মলাট দিতাম এই আঠা দিয়েও। সজনে গাছের আঠার কথা বলি। এই গাছের আঠা কিন্তু ওষুধেরও কাজ করে। সজনের আঠা দুধের সঙ্গে খেলে বা কপালে মালিশ করলে মাথাব্যথার উপশম হয়। শরীরে হওয়া ফোঁড়ার উপর সজনের আঠার প্রলেপ দিলে উপকার পাওয়া যায়। ধুনো ও গুগ্গুলও কিন্তু একধরনের আঠা। যা তৈরি করা যায় না, প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতে হয়।

সহজ-সরল এই জিনিসগুলি প্রকৃতির কাছাকাছি না থাকলে কিংবা তাকে ভালো-না-বাসলে কখনোই পাওয়া যাবে না। ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষে এলো, তাদের প্রধান ভাবনাই ছিল শস্যশ্যামলা দেশটির সম্পদ লুট করা। নিধন, শাসনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতেও পিছপা হয়নি ব্রিটিশরাজ। ভারতের বনসম্পদের দিকেও তাদের কুনজর পড়ে। এ দেশের সুবিশাল অঞ্চল তো ‘জঙ্গল’ হয়ে পড়ে নষ্টই হচ্ছে, তাই তা লুট করো। কেটে ফেলো গাছগাছালি। রাতারাতি সাহেবরা সাবাড় করে দিল জঙ্গলের গাছ অর্থাৎ কাঠ। এরপর জাহাজপথে নিজেদের দেশে পাঠিয়ে তারা ‘বড়লোক’ হল। পরিবেশবিদ সঞ্জীতকুমার সাহার একটি লেখায় পড়েছি, নিজেদের দেশে সেই কাঠ যেমন পাঠানো যাবে তেমনি প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তৈরিতেও কাজে লাগবে। আবার জঙ্গল সাফ হলে চাষাবাদের বিষয় উঠে আসবে। তখন ‘প্রজা’দের কাছে থেকে প্রভূত পরিমাণে রাজস্ব আদায়ের সুযোগ তৈরি হবে। তৎকালীন সাহেবদের মাথায় এইসব চিন্তা এসে ভিড় জমাতে থাকে। মহানন্দার জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে কিছু মানুষের মুখে শুনেছি পাইন, শাল, আঠাগোটা গাছ নির্বিচারে কাটা হয়েছিল। এই পাইনের রস থেকে তার্পিন তেল তৈরি হয়। বেহালা, এসরাজ, সারেঙ্গি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের ছড়ে পাইন গাছের শুকনো ও জমাট আঠা ঘষা হয়। একে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় ‘রজন’ বলে। ধুনো, গালা, হিং প্রভৃতি এর উদাহরণ। এরকমই আরেকটি আঠা নিঃসারী গাছের নাম আঠাগোটা। আঞ্চলিক নাম বওড়া। রংটংয়ের টয়ট্রেন লাইনের ঠিক ধারে এমন গাছ দেখেছি। ধনেশ পাখির পছন্দের এই গাছের ফল। আমাদের গাইড বলেছিলেন, সে ঘুড়ি তৈরি করত এই ফলের আঠা দিয়ে। ‘শাল দামার’, ‘ধুম’ বা ‘রাল’ নামে পরিচিত একধরনের সুগন্ধি আঠার উৎস শালগাছের কাণ্ড। নৌকার ছিদ্র বন্ধ করতে, টাইপ মেশিনের ফিতে, কার্বন পেপার, বার্নিশ ও রং তৈরির উপাদান হিসেবে কাজে লাগে এই আঠা। চামড়ার রোগের ওষুধ রূপেও যা অদ্বিতীয়। এখন আইন করে গাছ কাটা বন্ধ হলেও চোরাকারবার চলে বলে অভিযোগ।

আরও পড়ুন
যন্ত্রণা কিংবা অবহেলায় শব্দ করে কাঁদে গাছেরাও, জানাচ্ছে সাম্প্রতিক গবেষণা

আসব ল্যাটেক্স-এর (Latex) কথায়। যার কথা প্রথম জেনেছিলাম গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। কী এই ল্যাটেক্স? এর কাছাকাছি বাংলা তরুক্ষীর, যা উদ্ভিদের বহু রকম বর্জ্যপদার্থের অবদ্রব। পেঁপে, কাঠগোলাপ, দুধিলতা, আকন্দ ইত্যাদি গাছের কাণ্ড ভাঙলে দুধের মতো সাদা এই তরুক্ষীর বেরিয়ে আসে। গুগল জানাচ্ছে, তরুক্ষীরের জলীয় দ্রাবকের মধ্যে অনেক রকমের প্রোটিন, উপক্ষার, রজন, আঠা ইত্যাদির অণু দ্রবীভূত এবং অবলম্বিত অবস্থায় থাকে। এমনই এক উদাহরণ পপি গাছ। যার ল্যাটেক্স থেকে হেরোইন তৈরি হয়। আম, শিরীষ, সজনে, কাঁঠাল গাছের আঠা সম্পর্কে অনেকেই জানেন। যদিও আমগাছের ক্ষেত্রে আঠা নিঃসৃত হওয়া একটি রোগ। একে ‘আগমরা রোগ’ও বলে। এই সময় আমগাছের ছোট ডাল ও শাখাপ্রশাখা থেকে আঠা ঝরে। প্রাথমিকভাবে, ছোট বিন্দু আকারে আঠার ক্ষরণ দেখা যায়। যদিও রোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শাখাপ্রশাখা বা ডাল থেকেই আঠার ক্ষরণ হতে থাকে। রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে গাছের সমস্ত শাখাপ্রশাখা মরে যায় ও বাকলে চিড় ধরে। অন্যদিকে, বটের আঠা পা ফাটা ঠিক করে। ক্ষীরী বৃক্ষ পাকুড়ের পাতা ছিঁড়লে সাদা আঠা বের হয়। নিমগাছের আঠা কেমিক্যাল শিল্পের কাঁচামাল ও রেশম কাপড়কে রঞ্জিত করে। এ ছাড়া বাবলা গাছের আঠা ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ। বেদনানাশক। বাবলার আঠাতে উদরাময় এবং আমাশয় উপশম। কবিরাজি চিকিৎসায় বহুমূত্র ও শ্বাসকষ্টের জন্যও এর আঠার ব্যবহার করা হয়। তাছাড়াও সুগারের রোগীদের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে বাবলা আঠা। বাবলার আঠা খারাপ কোলেস্টেরল কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল বাড়ায়। শরীরে চর্বির পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থাৎ ওজন নিয়ন্ত্রণ করে বাবলা-আঠা। মহিলাদের স্তনের দুধ বাড়াতে হলে জিওল গাছের আঠা শরীরের পক্ষে খুব বলকারক। প্রসবের পর স্তন্যদাত্রীদের বুকের দুধ কমে গেলে তিন থেকে চার গ্রাম আঠা ঠান্ডা জলের সঙ্গে কয়েকদিন খেলে ফল মেলে। আপাতত এটুকুই। বৃক্ষজাত আঠাকে গঁদের আঠা বলে। নানান দপ্তরি শিল্পে এই আঠার বিশেষ প্রয়োজন। দেওয়ালে চুনকাম করার কাজেও এই আঠার প্রয়োজন। পোস্ট অফিসগুলোয় দেখেছি ক্যামেল, অশোকা কোম্পানির আঠা রাখা থাকতে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে বৃক্ষই প্রধান। আঠাসহ আরও বহু উপকারী জিনিস পেতে হলে বৃক্ষনিধন করা চলবে না। তোতাপাখির মতো এ বুলি আমাদের শেখা উচিত। আঠা আসলে গাছেদের রক্ত। কুঠারের আঘাতে গাছেদেরও যে রক্ত ঝরে।

আরও পড়ুন
গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি সেতু, মেঘালয়ের অনন্য বিস্ময়

Powered by Froala Editor