প্রায় সত্তর বছর আগে কালীবাবু ওরফে কালীপদ পাল চাঁপাডাঙা বাজারে গিয়ে জামাপ্যান্টের পিস কিনেছিলেন। ল্যাংটো বয়স পার হয়েছে। সঙ্গে বাবার দীনতা। সংসার তো চালাতে হবে। ছোট বয়সে অনেক বড় হতে হবে তাকে। আর কত বড়? বয়স তখন শিশুকাল ডেঙায়। কলকল করে ছোটনদী গীত হত একসময়। তার আগে বলি, বাজার ঘেরা ‘কবেকার কথা’। হাতে ছিল সত্তর টাকা। এটুকুই জমেছিল হাতখরচের টাকায়। বাবা দিত কিছু টাকা। বকশিশ দেব বলে নিয়ে যেত চাষ করাতে। ধান বোনা, গম বোনার সঙ্গে চলত মাটি মাখা, জল ঘাঁটা আর আল ধরে ছুটে চলে যাওয়া। ‘কদ্দূর যাস কালী?’—উত্তরে তার কণ্ঠ বোবা হয়ে যায়। কালীর কণ্ঠ যেন শাস্তি পেয়েছে। বাবার কাছ থেকে পরে তো আরও বড় শাস্তি পেতে হতে পারে! কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা না করে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে ছুট দিত। মাঠফড়িং পঙ্গপালেদের ধরতে যেত। লাফাত। ধানক্ষেতের পশ্চিম দিকটায় বলদ খেলত। পা টিপটিপ ঝপাংঝপাং। গরুর লেজ টেনে ধরত সে। যতক্ষণ না হাম্বা বলে দে দনাদন বলত, লেজ ধরে চলত খুনসুটি। তারপর হাতে পাটকাঠি নিয়ে গাছেদের 'শাসন' করতে করতে ছুটে চলে যেত। জায়গাটার নাম ছিল চাঁপাডাঙা। হাতে ছিল সত্তর টাকা। এ যেন সন্ধিক্ষণ। বয়স ডেঙানোর সন্ধিক্ষণ। শিশুমুখ যেন শেষবারের মতো সাড়া দেয়— ছো কিতকিত ছোওওওও...।
একটু বড় হল কালী। ঠা-ঠা রোদ যেন কর্তব্যের তেজটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। চাষের জমিতে সে তার বাবার হাত শুঁকে ফসল ফলাত। ছোটবেলার এই শেখা বড় হয়ে কাজে লাগল কালীর। এরপর ফসল ফলল। কিন্তু তা চাষের জমিতে নয়।
তারকেশ্বরের রেলগেটের ওখানে কালী দেখতে পেত অনেক সাজানো মানুষ। নীল মানুষ। লাল মানুষ। কখন দেখল সে এসব? দেখল তখন, যখন ধানের অঙ্কুর হবে না। চারা হবে না। ফুটিফাটা মাঠ। যেন খরা হয়েছে। তবুও যেত কালী। হাঁটতে হাঁটতে। এমন কোনও খরার সময় সে ডেকে নিল ওই নীল মানুষটিকে। ‘ব্যোমশংকর ব্যোম ছটকা, উড়ে যা বড় ঘরের মটকা – ডুগডুগি বাজিয়ে তেড়ে এলো নীল মানুষটি। ডুগডুগি থামল না। ক্রমক্রম... ভবব্যোমবম ব্যোম ব্যোম...’ অদ্ভুত হাঁকে মানুষটি বলা শুরু করল, ‘ব্যোম কেদার, গাঁজা খাও দেদার। যে খায় না গাঁজাগুলি, তাকে কি মানুষ বলি? যে বলে গাঁজা খাচ্ছি, তার বাঁজা সাতগুষ্ঠি। আর যে বলে গাঁজা ভালো, তার বেঁচে থাকুক আণ্ডাবাচ্চা। রাজার ছেলে ফকিরি করে, ধনীর বেটি ঝিগিরি করে। গাঁজা তো পুঁজি, তার মহাজনকে খুঁজি। ব্যোম কেদার। ব্যোম কেদার, গাঁজা খাও দেদার।’
কিছু না বুঝে কালী তাদের প্রশ্ন করে, ‘তোমার গরম করে না গো?’
আরও পড়ুন
অঙ্কের জাদুতে তিনি নিউটনের ‘ভাই’, অথচ জীবন কেটেছে দাস হিসেবে
―কেন রে বেটা?
আরও পড়ুন
বসন্তকে স্বাগত জানায় জীবন্ত সাপেরা, নির্ধারণ করে কেমন যাবে নতুন বছর!
—এত রোদে গায়ে রং করেছ কেন? এত মোটা পোশাক কেন? চুলে ওমন জট কেন?
—শালা কুত্তার ছাও। বেতমিজ ছেলের কথা শোন! চুপ কর। পাপ হবে।
—কেন পাপ হবে?
—আমরা বহুরূপী বলে।
বুঝতে পারে না কালী। তখনও তার কাছে মানুষগুলি রঙিন। লাল-নীল। সাদা মনে প্রশ্ন ওঠে, মানুষটি শিবঠাকুর কেন সেজেছে? কেন সে ডুগডুগি বাজাচ্ছে? কেন 'বোমবোম' বলছে?
আসলে এ এক বহুরূপীর গল্প। চরিত্র কাল্পনিক নয়। গল্পটা কিছুটা কাল্পনিক। এমনই এক চরিত্র খুঁজে পেয়েছিলাম তারকেশ্বর রেলগেটের কাছের এক জায়গায়। হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছি যখন, ডাকলেন একজন। কাউকে খুঁজছি কিনা জানতে চাইতেই বললাম, খুঁজছি কালীপদ পালের বাড়ি। উনি তারকেশ্বর রেলগেট অঞ্চলের বহু পুরনো বহুরূপী। জানালেন, রেলগেটের পাশ দিয়ে যে রাস্তা, সেই রাস্তা ধরে খানিক এগিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই দেখতে পাওয়া যাবে সাইনবোর্ড। তাতে লেখা― ‘প্রো: কালীপদ পাল/ বহুরূপী সেন্টার/ বাঘ ভাল্লুক সিংহ ও বিভিন্ন দেবদেবীর আকর্ষণীয় পোশাক পাওয়া যায়।’
শুরুতেই যে গল্প দিয়ে এ লেখার শুরু, তা কালীপদবাবুর কাছেই জানা। তারপর শিবঠাকুরের সঙ্গে কালীর দেখা হওয়া জীবনকে যে কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলল, কে জানে! প্রশ্ন করতেই ঝাঁঝিয়ে এল উত্তর, ‘বহুরূপী হতে গেলে পাগল হতে হয়।’ কেন এমন বলছেন জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘শিবঠাকুর যদি না আইত, এ জীবন বৃথা যেত।’
—আপনি যখন সাজেন, তখনও কি আপনি কালীপদ পাল ?
—হ্যাঁ, আমি তখনও কালীপদ।
―না মানে, আপনি ধরুন শিব বা হরি সাজলেন, আপনাকে কেউ পায়ে হাত দিয়ে ঈশ্বর জ্ঞানে প্রণাম করল, তখন কেমন মনে হত আপনার?
—প্রণাম অত সহজ নয়।
থমকে যেতে হয় এরপর। কী বলব! আমরা তাঁর সাজঘর দেখতে গিয়েছিলাম। যে ঘরটায় কালীবাবুর সঙ্গে ‘আড্ডা’ চলছিল, সেই ঘরের সামনের মুক্তাঞ্চল পেরিয়ে ডানদিকের ঘরটাই সাজঘর। ঘরে ছিল অনেক কিছুই। মা কালীর মুণ্ডমালা থেকে নানান রং-বেরং-পরচুলো— আর মুখোশও। বহুরূপীর ঘরে মুখোশ! জানালেন, মাঝেমাঝে তাঁরাও মুখোশ পরেন। বাঁ-দিকের দেওয়ালে ঝুলছে ব্যাধের মুখোশ। জানালেন, ‘বাবার মাস’ শ্রাবণে বেশি পরতেন এসব মুখোশ। ওই সময়টায় এখানে অনেক লোক আসে। শ্রাবণ মাস জুড়ে মেলা বসে। রাতদিন এক হয় তখন। ‘মহাদেব আমায় ভিখিরি বানায়নি। ওর অনেক কৃপা’।
যে সময়টায় তাঁর কাছে গিয়েছিলাম, অশীতিপর তিনি। নিজে না সাজলেও অনেকেই সাজতে আসে। তাদের সাজিয়ে দেন। কিছু বকশিশও মেলে। ‘ভাবি, বুড়ো বয়সেও কাজ করছি। ভালোই তো লাগে’!
—একটা অভিজ্ঞতা বলবেন আপনার? মুখোশ পরার অভিজ্ঞতা। যেমন ধরুন, আপনি এই ব্যাধের মুখোশ পরলেন... তারপর কী করেন? কোনও গান করেন? কী বলেন?
—হাতে তিরধনুক নিই। আর গান ধরি, ‘আমি শিকারি গো শিকারি/ রংবেরঙের পাখি ধরি গো/ রংবেরঙের পাখি।/ সবাই ভালোবেসে করে ডাকাডাকি,/ আমি জঙ্গলেতে থাকি।/ নাইকো আমার ঘরবাড়ি! মুখে মুখে ছড়া কাটানোর মতো করে বানানো এই গান। কিন্তু এসব শুনে কী হবে তোমাদের? বহুরূপী হওয়া অত সহজ নয়। বাবুদের কাছ থেকে ভালোমন্দ শুনতি হত প্রায়। ওরা তোমাকে নিয়ে মশকরা করবে। পাগল ভাববে। এসব সইতে পারাও সহজ নয়। তোমাদের মতন কেউ তখন ওখানেও থাকবে। তারা ছবি তুলবে। কষ্টকষ্ট ভান করবে। কিন্তু বুঝবে না।’ আর কথা বাড়াইনি। ততক্ষণে জেনেছি, কালী সাজার রেট একটু বেশি ইদানীং। ভারী গয়না দিতে হয়। যখন বেরোচ্ছি, কালীবাবুর নাতি গণেশের মুখোশ পরে বাঘ পড়ার মতো করে লাফিয়ে আমাদের সামনে পড়ল। আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল শরৎচন্দ্র― ‘‘আধো অন্ধকারে হঠাৎ বারান্দায় লাফ দিয়ে পড়ল বাঘ। মেজদা তখন তাঁর ভাইদের নিয়ে পিলসুজ জ্বেলে পড়তে বসেছেন। আর বাঘ লাফিয়ে পড়তেই মেজদা পিলসুজ উল্টে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সড়কি লাও, বন্দুক লাও— আওয়াজ উঠল।/ পশ্চিমি দারোয়ান বন্দুক তাক করতেই সেই বাঘ মানুষের গলায় কেঁদে উঠল, ‘আমি বাঘ নই। ছিনাথ (শ্রীনাথ) বহুরূপী’।’’
ছবি : প্রতীকী
Powered by Froala Editor