ভয়! রোজকার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা শব্দ। ছোটোবেলায় ভয় ছিল ভূত নিয়ে। আর আজ ভয় ধরিয়েছে বিশ্বাসভঙ্গের আতঙ্ক, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, এই ঘষটে চলা জীবন। ‘ভূত’ যে কখন বর্তমান হয়ে গেছে টের পাইনি। মাঝেমধ্যে মনে হয় সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু বড়ো হওয়ার অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে, তা সম্ভব নয়। পালাতে না পেরে নিজেকে পালটাতে হয় তাই। এরচেয়ে বোধহয় ভূতেরাই ভালো ছিল। মানে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের (Shirshendu Mukhopadhyay) ‘অদ্ভুতুড়ে’-র ভূতেরা। তাঁদেরকে যদি সঙ্গে পেতাম, তাহলে এক নিমেষে বদলে দিতাম দুনিয়াটাকে। কিংবা সেই ছোট্টবেলায় ফিরে গিয়ে নিষ্পাপ চোখে আবার দেখতাম চারপাশটা।
কাঁধে হাত দিয়ে এই আশ্বস্ত করাটাই ‘অদ্ভুতুড়ে’-র ভূতেদের আসল শক্তি। ব্যক্তি আমি বা আপনি নয়, বরং এক বড়ো প্রেক্ষাপটে ভূতেরা বিস্তার করে থাকে তাঁদের ‘ছায়া’। বাংলা সাহিত্যে ভালো ভূতেরা ছিল আগেও। মনে পড়তে পারে উপেন্দ্রকিশোরের ‘ভূতের রাজা’-র কথা। কিন্তু তাঁর তো প্রচুর ক্ষমতা। আর ‘অদ্ভুতুড়ে’-র অধিকাংশ ভূতই আসলে ছাপোষা মধ্যবিত্ত। বেঁচে থাকতে আমাদের যতটুকু দৌড়, তাঁদেরও ঠিক ততটুকুই সামর্থ্য। আর সেই কারণেই ভয় নয়, বিশ্বাস করা যায় তাঁদের। ধরা পড়ে মানবচরিত্রের বহু মাত্রা। অদ্ভুতুড়ে-তে নবজন্ম ঘটে বাংলার ভূতের। জন্ম নেয় নতুন রূপকথা।
কবির ভাষায় সকলেই ভূত নয়, কেউ কেউ ভূত। কিছু শর্ত আছে তার জন্য। এমনকি, কে কেমন ভূত হবে সেটারও কিছু নিয়মকানুন আছে। ভিনগ্রহ থেকে আসা রামরাহার অতি বৈজ্ঞানিক ঘড়িটা লাটুকে বলেছিল, “ভূত হল মানুষের মানসিক-আত্মিক একটা অস্তিত্ত্ব। মানুষের মন আর চরিত্র জ্যান্ত অবস্থায় যেমন ছিল, মরার পর তার ভূতের চেহারাটা ঠিক সেরকম হয়ে যায়”। আর ভূত ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে অনুভব করার বিষয়। তার সাথে কথা বলা যায়, কিন্তু তা আসলে চিন্তার তরঙ্গ। ভূতেদের দেখা পাওয়া যায়, কিন্তু কিছু বিশেষ মুহূর্তে। ‘হেতমগড়ের গুপ্তধন’-এ নন্দকিশোর মুনসি মাধব বাবুকে বলেছিল, “বিপদে পড়ে আপনার চোখ কান নাক ইন্দ্রিয় এবং স্নায়ু অত্যন্ত বেশি সজাগ হয়ে ওঠায় অনুভূতির ক্ষমতা বেড়ে গেছে”।
ভূতেদের সম্পর্কে এরকম যুক্তিপুর্ণ ধারণা ‘অদ্ভুতুড়ে’-র পূর্বসূরীদের কাছে নেই। ভূতেদের কাছেও ছিল না। তাই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাতে ভূতেদের এক মুক্তাঞ্চল তৈরি হয়। বাংলার সমস্ত প্রান্ত থেকে ভূত এসে জড়ো হয় সেখানে। বিভিন্ন সামাজিক অবস্থান, বিভিন্ন পেশা, বিভিন্ন গ্রামের ভূতেদের এক মহাসম্মেলন ঘটে ‘অদ্ভুতুড়ে’-তে। একদিকে রাজা চন্দ্রকুমার (ছায়াময়) যেমন আছেন, তেমনই আছে দেহাতি ভূত গানা আর বাজানা। একদিকে যেমন ভীম সরকার (চক্রপুরের চক্করে) আর কালীচরণ (ঝিলের ধারে বাড়ি)-এর মত দৌর্দন্ডপ্রতাপ জমিদার আছেন, তেমনই শান্ত সমাহিত ভাল মানুষ সাহেব (পাগলা সাহেবের কবর)-ও আছেন।
আরও পড়ুন
ব্রাউন লেডি, এক ‘সত্যি’ ভূতের ছবি
অদ্ভুত তাঁদের সামাজিক বিন্যাস। নির্বাচন আছে, গণতন্ত্র আছে। আবার একঘরে করে দেওয়ার ভয়ও আছে। ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’-এ নিধিরামকে পেয়ে বসেছিল সেই ভয়টাই। তবে এখন রাজতন্ত্র না থাকলেও রাজাসুলভ অহংকারটা যাবে কোথায়? যেমন চাপাঁকুঞ্জের এক সময়ের রাজা কালীচরণ। তিনি ‘ঝিলের ধারে বাড়ি’ উপন্যাসের নবীনের উর্ধ্বতন ষষ্ঠপুরুষ। যার নামে কুলদা চক্রবর্তীর মত ব্রাহ্মণ ভূত আজও ভয়ে কাঁপে। ‘চক্রপুরের চক্করে’-তে ভীম সরকারের ভূতের ভয়ে মানুষ আজও শুখানালার জঙ্গলে যেতে ভয় পায়। সেখানে কখনও শুকনো নালা বেয়ে অদৃশ্য জল ধেয়ে আসে, কখনও-বা অদৃশ্য অশ্বারোহী সৈন্যরা ঘোড়া ছুটিয়ে আক্রমণ করে আগুন্তুককে। ‘মদন তপাদারের বাক্স’-তে বৃদ্ধ রাজা হরিশ্চন্দ্রের ভূত এসে প্রায়ই ধমক দিয়ে যান, কেন খাজনা ঠিকঠাক আদায় হচ্ছে না। রাজত্ব নেই, সৈন্য নেই, অস্ত্রশস্ত্র নেই, অর্থ নেই, এমনকি শরীরটা পর্যন্ত নেই, কিন্তু আধিপত্যটা তাঁরা বজায় রেখে চলছেন।
আরও পড়ুন
পুনরায় ভূত চক্কর, ভূত ডম্বরু, শূন্য ভবিষ্যৎ
‘অদ্ভুতুড়ে সিরিজ’-এর ভূতেদের সঙ্গে আলাপচারিতার পরে মনে হয় এই উপন্যাসগুলো শুধুই ভূতুড়ে নয়, তার চেয়েও বেশি অদ্ভুত! কতকগুলি ভূতেদের কীর্তিকলাপ বর্ণনাই এই কাহিনির উদ্দেশ্য নয়, বরং নিছক ভূতের গল্পের আড়ালে রয়েছে আরো কিছু। আসলে ভূত মানে তো শুধুই বায়বীয় সত্তা নয়, তা তো মানুষেরই অতীত। সেই কায়াহীন অতীতকে যখন আজকের মানুষের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই সাক্ষাতের মধ্যে থেকেই উঠে আসে বিভিন্ন সামাজিক প্রসঙ্গ। কেমন লাগে নিজেকে সেই আয়নায় দেখতে? একা লাগে নিজেকে? মনে হয়, বড়ো বেশি মুখোশ পরে ঘোরা হচ্ছে আজকাল। উপরে ওঠার লড়াইয়ে প্রতিমুহূর্তে হত্যা করতে হচ্ছে মানবিকতা। সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া, ভূত হয়ে যাওয়া মূল্যবোধগুলির নবজন্ম হয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কলমে। আর সেখানেই শুরু হয় ‘অদ্ভুতুড়ে’-র আলোচনা।
তাঁরা শক্তি দিয়েছে, সাহস দিয়েছে, পিঠে হাত রেখে ‘বোকা’ মানুষকে বিশ্বাস দিয়েছে। ভুল পথে চালিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি চায়নি। অতীতের গরিমা শুনিয়ে দল ভারি করতে চায়নি। ‘অদ্ভুতুড়ে সিরিজ’ এই ‘ভূত’ হয়ে যাওয়া ভালো মানুষগুলোর ফিরে আসা। যার আজ দরকার, খুব দরকার।
Powered by Froala Editor