পরগনার নাম তরপ। গ্রাম মিরাশী। সুরমা উপত্যকার এক ছোট্ট বসতি। আশ্বিন-কার্তিক মাসে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পড়ে শালিধানের মাঠ। ময়না-শাইল, কার্তিক-শাইল, কৃষ্ণচড়া—কত বাহারি নাম ধানেদের। সেরকম অপূর্ব গন্ধ। দু-হাতে তার রূপ-রস মেখে আল দিয়ে পথ চলতে চলতে গান ধরেন জমিদার হরকুমার বিশ্বাসের ছেলে। ‘অহো’ শব্দে তারিফ ভেসে আসে হাল বাওয়া চাষিদের থেকে। চুপ করে গেলে মাঠের কোণ থেকে দাবি উঠত, “কই লালুবাবু? চালাও।” বাড়িতে হরেক রকম লোকসঙ্গীতের আসর বসত। শুনে শুনে সব গান তুলে নিয়েছিলেন লালু। যাকে সারা বাংলা চেনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস (Hemanga Biswas) নামে। দেশভাগের বহু পরে কলকাতায় বসে সেই ছোট্ট গ্রামখানির স্মৃতিতে লিখেছিলেন,
“কার্তিক মাসে বুকে ক্ষীর খেতে ধানে ধানে
অঘ্রানে রান্ধুনি পাগল নয়া ভাতের আঘ্রাণে।”
এই গান লেখার কথা ছিল না তাঁর। মৃত্যুর বিভীষিকায় স্তব্ধ হয়ে যেতে পারত জীবন। প্রাণ ফিরে পেলেও হয়তো চিরকালের জন্য কণ্ঠ থেকে মুছে যেত গান। কারণ, যক্ষ্মা। কংগ্রেসি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে জেলে বন্দি থাকার সময় ভিতরে ভিতরে বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন তখনকার সময়ের প্রাণঘাতী রোগ। মোটামুটি তিনের দশকের শুরুর দিকের ঘটনা সেটা। হেমাঙ্গের বয়স তখন ২০-২১। একদিন দুপুরে হঠাৎ-ই শুরু হল রক্তবমি। রোগ ধরা পড়তে বেশিক্ষণ লাগল না। জেলে চিকিৎসা সম্ভব নয়। তাই হেমাঙ্গ যদি বন্ডে সই করে মুক্তিপ্রার্থনা করেন, তাহলে বাইরে ভালো হাসপাতালে ভর্তি করা হবে তাঁকে। লিখতে হবে ছাড়া পেলে আর কোনোদিন রাজনীতি করবেন না। সহবন্দিরাও কিন্তু সম্মতি দিলেন প্রস্তাবে। যতই হোক, চোখের সামনে একজনকে তো মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। কিন্তু বেঁকে বসলেন হেমাঙ্গ স্বয়ং। জেলের প্রায় প্রত্যেক বন্দি এসে অনুরোধ জানিয়েছিল তাঁর কাছে। নরমে-গরমে বোঝানোর চেষ্টা করত জেলার সাহেব। কিন্তু না, ইংরেজের দাসখতে তিনি সই করবেন না। ১৩ মাস পরে যক্ষ্মার ভয়ানক প্রকোপ নিয়েই জেল থেকে ছাড়া পেলেন তিনি।
শিলংয়ে তখন প্রায়ই আসতেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় (Bidhan Chandra Roy)। একদিন সাহস করে তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হলেন হেমাঙ্গ ও আরেক জন বন্ধু। চিকিৎসাবিদ্যার ‘ধন্বন্তরী’ তিনি। নিশ্চয়ই তাঁর দেওয়া ওষুধে সুস্থ হয়ে যাবেন হেমাঙ্গ। কিন্তু ফিজ দেওয়ার মতো পয়সা তো নেই তাঁদের কাছে। সঙ্গের বন্ধুটি খাঁটি সিলেটি ভাষায় জানালেন সে কথা, “আমরা আপনেরে কুস্তা দিতাম পারতাম না স্যার।” এবার বিধান রায়ের চমকানোর পালা। “অ্যাঁ, কী বললে?” আবারও একই উত্তর। অবশেষে আসরে নামলেন হেমাঙ্গ। বললেন তাঁদের অপারগতার কথা। বাড়তি খাতির পাওয়ার জন্য যুক্ত করলেন জেল খাটার কথা। না, কোনো অর্থ নেননি বিধান রায়। লিখে দিয়েছিলেন দুটি ওষুধ। আর তার গুণেই গত দেড় বছরের মধ্যে এই প্রথমবার হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন হেমাঙ্গ।
আরও পড়ুন
অভিমানী দেবব্রত, ‘বিনোদিয়া’ বন্ধুর জন্য গান বাঁধলেন হেমাঙ্গ
কণ্ঠে ফিরে এল গান। কষ্ট হত, খুব কষ্ট। কোনো চিন্তা নেই। বিধান রায়ের ওষুধ আছে তাঁর সঙ্গে। কষ্ট গোপন করেই চলত গানের আসর। স্বাভাবিকভাবেই শরীর ভাঙতে বেশিদিন লাগল না। গান তো দূরের কথা, কথা পর্যন্ত বন্ধ। শরীরে আর যেন কোনো জোর অবশিষ্ট নেই। টিবি রোগের ভয় তখন হার মানাত ভূতের ভয়কেও। দ্রুত তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল কলকাতার কে. এস. রায় টিবি হাসপাতালে। এরও প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। সেখানেই চিকিৎসা শুরু হল হেমাঙ্গের। সে এক যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়া। সারাদিন শ্বাসকষ্ট, রাত্রি নিদ্রাহীন। আর প্রতিদিনই কোনো না কোনো রোগীর মৃত্যুসংবাদ। তবু তো মানুষ খড়কুটো ধরেও বাঁচতে চায়। মৃত্যু যাঁদের ঘনিষ্ঠ, জীবন তাঁদের কাছে আরো বেশি প্রিয়। তাঁদের মধ্যেই গড়ে উঠল বন্ধুত্ব। গান না হোক, কবিতা-গল্প তো চলতেই পারে। তৈরি হল পেশেন্টস রিক্রিয়েশন ক্লাব। স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার নতুন নাম রাখলেন ‘নবজীবন’। কয়েক মাসের মধ্যে হেমাঙ্গও পেলেন নবজীবনের সন্ধান। তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার পর ভর্তি হন বিজন ভট্টাচার্য। তারপর সুকান্ত। তিনি আর হাসপাতাল থেকে ফেরেননি।
আরও পড়ুন
‘তুমার রবীন্দ্রসঙ্গীতটা হইব না’, হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে বললেন দেবব্রত
এই হাসপাতাল শুধু তাঁকে জীবন ফিরিয়ে দেয়নি, দিয়েছিল নতুন জীবনের সন্ধান। অনিলেন্দ্র রায় নামের এক রোগীর কাছে প্রথম দেখলেন মার্কসের ‘কাপিটাল’। এতদিন শুধু নামই শুনে এসেছেন। বাংলার সাহিত্য ও রাজনীতিতে যে ধীরে ধীরে বদল আসছে, তার সামান্য আঁচ পেয়েছিলেন সিলেটে বসেই। এবার হাসপাতালে শুরু হল মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস অধ্যয়ন। তালিকায় রইল অসংখ্য বলশেভিক পত্রিকা। আক্ষরিক অর্থে হাসপাতালেই তাঁর দীক্ষা হল মার্কসীয় আদর্শে।
আজীবন সেই বিশ্বাস আঁকড়ে বেঁচে ছিলেন তিনি। কিন্তু তা বলে অন্ধ আনুগত্যে বিশ্বাসী নন। কমিউনিস্ট পার্টির একাধিক সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। পার্টির দাসত্ব করার জন্য সমালোচনা করেছেন গণনাট্য সংঘকে। বিতর্ক আছে, বিরোধিতা আছে। আর আছে গান। সেই ছোটোবেলার মতো ধানের ক্ষেতে জড়িয়ে থাকা ‘রান্ধুনি পাগল’ ভাতের স্বপ্ন। শরীরের কোনো রোগ থামাতে পারেনি তাঁর কণ্ঠ। যতবার নিজেকে মনে হয়েছে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ততবার যেন নিজের ভিতর থেকে শুনতে পেয়েছেন, “কই লালুবাবু? চালাও।” কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল নয়, সেই গানের শ্রোতা মেহনতি জনতা। ‘দেশেই আমার নাটঘর রাইজেই ভাওরীয়া’। অর্থাৎ দেশই আমার মঞ্চ—জনতা, অভিনেতা।
Powered by Froala Editor