১৮৮০ সাল। সদ্য বি.এ পাশ করা এক যুবকের কাছে এল বিলেতযাত্রার সুযোগ। প্রথমে ইচ্ছে ছিল আই.সি.এস পরীক্ষা দেবেন। কিন্তু বেঁকে বসলেন পিতা ভগবানচন্দ্র বসু। নিজে ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, জানতেন ইংরেজের ‘চাকরবৃত্তি’-র যন্ত্রণা। পাশাপাশি অর্থব্যয় করতেন অসংখ্য স্বদেশি শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য। ঋণের বোঝা ছিল নিত্যসঙ্গী। তাই পুত্র যখন মত পরিবর্তন করে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া ঠিক করলেন, তখন বাধা হয়ে দাঁড়াল অর্থ। কিছুদিন আগেই এক জটিল রোগ থেকে সুস্থ হয়েছেন ভগবানচন্দ্র। সরকারি মাইনে হয়ে গেছে অর্ধেক। মা বামাসুন্দরীও সহমত হলেন না একমাত্র ছেলের সিদ্ধান্তে। অন্য এক সন্তানকে হারিয়েছেন আগেই, আরেক সন্তানও চলে যাবে দূরদেশে। তাহলে কি উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে জগদীশচন্দ্রের (Jagadish Chandra Bose) কাছে? না, অনুমতি মিলল মায়ের তরফ থেকে। প্রয়োজনে অলঙ্কার বিক্রি করেও তিনি ছেলের বিদেশ যাওয়ার অর্থ জোগাবেন। তার অবশ্য প্রয়োজন হয়নি শেষ পর্যন্ত।
জগদীশচন্দ্রের যাত্রা শুরু হল লন্ডনের এক হাসপাতালে। কিন্তু এবার বাধা হয়ে দাঁড়াল স্বাস্থ্য। অগত্যা ১৮৮১ সালে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হলেন কেমব্রিজের একটি কলেজে। তিনবছর পর প্রকৃতি বিজ্ঞানে ‘ট্রাইপস’ পাশ। এবার ঘরে ফেরার পালা। দেশের বিজ্ঞানসাধনাকে পৌঁছে দেবেন বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে। চোখে আকাশকুসুম স্বপ্ন নিয়ে হয়তো ভুলেই গেছিলেন যে দেশটা পরাধীন। ভারতের মানুষ আবার বিজ্ঞানী হতে পারে নাকি? তাঁরা তো জন্মেছেই ইংরেজের সেবা করার জন্য! তাই লর্ড রিপনের সুপারিশ সত্ত্বেও শিক্ষাদপ্তরের কর্তা আলফ্রেড ক্রফট ও প্রেসিডেন্সির প্রিন্সিপাল চার্লস টনি পদে পদে বাধা সৃষ্টি করলেন জগদীশচন্দ্রের নিয়োগে। হাল ছাড়লেন না তিনি। অস্থায়ী ভাবেই কাজে যুক্ত হলেন।
কিন্তু মাইনে যে যৎসামান্য। এমনকি স্থায়ী হলেও মাইনে পাবেন ইউরোপীয় অধ্যাপকদের এক-তৃতীয়াংশ। এবার বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন জগদীশচন্দ্র। বাড়িতে অভাব, দেনার দায়ে ডুবে গেছেন পিতা। সংসারের প্রায় সব দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। তাতেও তিনি ব্রিটিশের এই ভিক্ষার দান গ্রহণ করবেন না। কাজ চালিয়ে গেলেন বিনা মাইনেতেই। টানা তিন বছর এই অহিংস প্রতিবাদ চালানোর পর অবশেষে হার মানতে বাধ্য হয় ইংরেজ সরকার। বর্ধিত হারে ন্যায্য মাইনের সবটুকু ফিরিয়ে দেওয়া হয় জগদীশচন্দ্রকে।
অর্থের সমস্যা তো ছিলই, তার চেয়েও বড়ো সমস্যা ছিল পরিকাঠামোর অভাব। বৈষম্যের ধ্বজা উড়ত সেখানেও। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে হাইনরিখ হার্ৎজের বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব বিষয়ক দীর্ঘ গবেষণা। জগদীশচন্দ্র মেতে উঠলেন হার্ৎজের অসমাপ্ত গবেষণা সম্পূর্ণ করার কাজে। কিন্তু অদৃশ্য তরঙ্গ সৃষ্টির যন্ত্র তো আর কলকাতায় মিলবে না। সেটাকে বানিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও তার জন্য উপযুক্ত ল্যাবরেটরি প্রয়োজন। প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকদের বসবার ঘরের পাশের বাথরুমটাকেই সাজিয়ে-গুছিয়ে ল্যাবরেটরি বানিয়ে ফেললেন জগদীশচন্দ্র। ১৮৯৫ সালে সেখানেই তিনি ৫ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ সৃষ্টি করেন। একই সঙ্গে তারহীনভাবে সেটিকে পাঠানো সম্ভব হল একস্থান থেকে অন্যস্থানে। তিনি লিখছেন, “অদৃশ্য আলোক ইটপাটকেল, ঘরবাড়ি ভেদ করিয়া অনায়াসে চলিয়া যায়। সুতরাং ইহার সাহায্যে বিনা তারে সংবাদ প্রেরণ করা যাইতে পারে।”
আরও পড়ুন
‘গাছের প্রাণ আছে’ – আবিষ্কার করেননি জগদীশচন্দ্র, রেডিও-র আবিষ্কর্তাও নন তিনি!
এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘ চেষ্টায় আরো সমৃদ্ধ হল তাঁর গবেষণা। বিভিন্ন বিজ্ঞানপত্রিকায় লেখা ছাপা হতে শোরগোল পড়ে যায়। আমন্ত্রিতভাবে বিদেশযাত্রার পর্ব শুরু হল জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসুর। ১৮৯৭ সালের ১৯ জানুয়ারি খোদ রয়্যাল ইনস্টিটিউশনের ডাকে একটি সভায় বক্তৃতা দিলেন তিনি। পরদিন ইংল্যান্ডের প্রায় সব পত্রিকাতেই ছড়িয়ে পড়ল আলোচনার খবর। অনেক বিজ্ঞানী প্রস্তাব করলেন, ভারত সরকার যেন অবিলম্বে একটি অত্যাধুনিক গবেষণাগার বানিয়ে দেয় এই বিজ্ঞানীর জন্য। হয়তো দায় এড়াতে না পেরেই প্রথমে ৪০০০ পাউন্ড খরচ করার প্রস্তাবে রাজি হলেও, পরে বছরে ২০০০ টাকার বৃত্তির বন্দোবস্ত করেই দায় এড়ায় তারা।
আরও পড়ুন
জগদীশচন্দ্রের লেখালিখির সম্পাদিকা, বসু বিজ্ঞান মন্দির গড়তেও সাহায্য করেছিলেন নিবেদিতা
তখনও হয়তো ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার সম্পূর্ণ চেহারা ধরতে পারেননি। ১৮৯০ সালে যখন দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড-ফ্রান্স সফরে গিয়ে সাফল্য পেলেন, তখন ক্রমেই ‘শত্রু’ বাড়তে লাগল তাঁর। তাঁদের অনেকে রাজপুরুষ, অনেকে বিজ্ঞানী। সামান্য মতবিরোধের সূত্রে অন্যায় আচরণ শুরু করলেন রয়্যাল সোস্যাইটির কিছু ব্যক্তিও। সেই সময় প্যারিসের ‘আন্তর্জাতিক সংসদ’-এর অধিবেশনে জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতা শুনতে উপস্থিত ছিলেন আরেক বাঙালি। তাঁর নাম স্বামী বিবেকানন্দ। সেই সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখছেন, “সে বহু গৌরবর্ণ প্রতিভামণ্ডলীর মধ্য হতে এক যুবা যশস্বী বীর, বঙ্গভূমির, আমাদের মাতৃভূমির নাম ঘোষণা করলেন—সে বীর, জগৎপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডাক্তার জে. সি. বোস।” বছর তিনেক আগে জগদীশচন্দ্রের আলাপ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। অল্প সময়ের ব্যবধানে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে দুই বিখ্যাত মনীষার। আর এই সময়েই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা।
রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে কিছুদিন গবেষণা করে যেতে চাইলেন জগদীশচন্দ্র। নিজের তত্ত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রমাণ করে তবেই তিনি ইউরোপ ছাড়বেন। কিন্তু ‘ছুটি’ দিতে রাজি হল না ভারত সরকার। পাশাপাশি বাধা হয়ে দাঁড়াল অর্থ। তাহলে কি ফিরে আসতে হবে ইংল্যান্ড থেকে? কোথাও যেন ছোটোবেলার স্মৃতি উঁকি দিয়ে যায় এই ঘটনায়। কারণ একই, শুধু পার্থক্যটা প্রেক্ষাপটের। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের একের পর এক চিঠি উৎসাহ জোগাল তাঁকে। লিখলেন, “য়ুরোপের মাঝখানে জয়ধ্বজা পুঁতিয়া তবে তুমি ফিরিয়ো।”
শেষ পর্যন্ত অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ছুটির বন্দোবস্ত হল। কিন্তু অর্থ? ফের সহায় উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোর দেবমাণিক্য ১৫০০০ টাকা পাঠান জগদীশচন্দ্রকে। রবীন্দ্রনাথ আরেকটি চিঠিতে লিখছেন, “তোমাকে বারম্বার মিনতি করিতেছি—অসময়ে ভারতবর্ষে আসিবার চেষ্টা করিও না।” সত্যিই তো অসময়। সে সময় ফিরে এলে চিরকালের জন্য এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর তত্ত্ব নিয়ে ভ্রূকূটি-সহ তাকাত ইউরোপীয় সমাজ। যোগ্য সম্মান থেকে জগদীশচন্দ্র বঞ্চিত হয়েছিলেন অনেক ক্ষেত্রেই। তবু সেদিন বিদেশের মাটিতে ভারতের জয়ধ্বজা উড়িয়েই ফিরেছিলেন তিনি।
Powered by Froala Editor