সমুদ্রমন্থনের শেষ পর্বে উঠে এসেছিল তীব্র বিষ। যার নাম ‘কালকূট’। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল মৃত্যুর মুখে পড়েছিল এই বিষের জ্বালা-যন্ত্রণায়। হিন্দু পুরাণ কাহিনির বিষ যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পৃথিবীর বুকে। আধুনিক সময়ে কোনো ‘নীলকণ্ঠ’ মহাদেব আসেন না ধরিত্রীকে রক্ষা করতে। রক্তের মধ্যে অবিরত একটা দহন নিয়ে পথচলা। শুধুই দেখতে থাকা ‘অমৃতস্য পুত্রা’ মানুষ ও তার অন্তহীন যাত্রা। তাই কি সমরেশ বসু (Samaresh Basu) নিজের ছদ্মনাম রেখেছিলেন ‘কালকূট’? নিজের জীবনে বারবার অশান্তির বিষ ঢুকেছিল বলেই কি মানুষের টানে পাড়ি জমাতেন ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’?
“কিন্তু এমন নামটি কেন? তাহলে যে প্রাণটি খুলে দেখাতে হয়। দেখলেই বোঝা যাবে, বুক ভরে আছে গরলে, আপনাকে খুঁজে ফেরা, আসলে তো হা-অমৃত, হা-অমৃত!... কালকূট ছাড়া আমার আর কী নাম হতে পারে?” এ তাঁর নিজের কথা। এই ‘আপনাকে খুঁজে ফেরা’ তো নেহাত পেশার তাগিদে নয়। বরং সেই ছোটোবেলা থেকেই শুরু হয়েছিল পথচলা। ১৯২৪ সালে ঢাকার রাজানগর গ্রামে তাঁর জন্ম। ডানপিটেপনার জন্য প্রথাগত পড়াশোনা বেশি দূর এগোল না। কৈশোরের প্রাকলগ্নে দিনের পর দিন কাটত শ্মশানের নিস্তব্ধতায় বসে। নতুবা স্থানীয় বন্ধুদের সঙ্গে স্কুল পালিয়ে চলত দূর-দূরান্তে বেরিয়ে পড়া।
সে-অর্থে ডানপিটে হয়তো ছিলেন না। পারিবারিক সূত্রে আঁকা-গান গাওয়ার প্রতি একটা ঝোঁক ছিল ছোটো থেকেই। নিজে বলছেন ‘কাব্যিক টান’। আর সেই টানের কারণেই রবীন্দ্রনাথের ‘অনধিকার প্রবেশ’ গল্পের প্রায় অনুকরণে একটি গল্পও লিখে ফেলেন। কিন্তু ত্যাগ করতে হল বুড়িগঙ্গার মায়া। এবারে ঠাঁই মিলল ভাগীরথীর পাশে নৈহাটিতে। দাদা মহেন্দ্রনাথের তত্তাবধানে শুরু হল নতুন জীবন। যদিও পুনরায় পড়াশোনার চেষ্টা টিকল না বেশিদিন। গঙ্গাপাড়ের চটকলের বস্তি অধ্যুষিত জীবনযাত্রার মধ্যে পেলেন আরো মহৎ এক শিক্ষা। খুব কাছ থেকে দেখলেন মানুষের রোজকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংগ্রামের সময় তখনও আসেনি। কিন্তু যারা প্রতিদিন মার খেতে খেতে সমাজের চোখে অপাংক্তেয় হয়ে যায়, তাদের ভিতরের বেঁচে থাকার আনন্দটুকুই ধারণ করলেন তিনি। শত যন্ত্রণার মধ্যে লড়াইয়ের এই প্রেরণাটুকু হয়ে রইল জীবনের একমাত্র রসদ।
তার সঙ্গে ক্রমাগত বেড়ে চলছিল বোহেমিয়ানা। প্রায়ই উধাও হয়ে যেতেন বাড়ি থেকে। গান গেয়ে বেড়াতেন বিভিন্ন জায়গায়। ফলে আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন, সেখানেও একই আচরণের পুনরাবৃত্তি। অবশেষে ১৬ বছর বয়সে প্রায় পাকাপাকিভাবে শুরু হল এপার গঙ্গার জীবন।
আরও পড়ুন
রাঢ়বঙ্গের মাটিতে ‘দেশ’-এর খোঁজ এবং বহুমতের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
এরপর গৌরী দেবীর সঙ্গে প্রেম এবং সমগ্র সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে দুজনের বিবাহ। একই সঙ্গে বামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যোগদান। ‘বাণী’ নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সেই সূত্র ধরেই শুরু হয় গল্প লেখার পালা। অনুকরণ-অনুসরণ থেকে ক্রমশ নিজের ভাষা খুঁজে পেলেন সমরেশ বসু। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত গল্প, ‘আদাব’। সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতির সম্ভাবনার মুখেই নেমে এল রাজনৈতিক বিপর্যয়। স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ায় জেলবন্দি হতে হয় তাঁকেও। চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হল। কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল, পার্টির সদস্যপদও কেড়ে নেওয়া হতে পারে তাঁর থেকে। জেলের বাইরে চার সন্তান নিয়ে গৌরী দেবীর তখন চূড়ান্ত দুরবস্থা। সমাজ, রাজনীতি, পরিচিত মানুষ অনেকের প্রতিই জন্মাতে লাগল তীব্র ক্ষোভ। জেলে বসেই তিনি রচনা করলেন ‘উত্তরঙ্গ’ উপন্যাস ও ‘লেবার অফিসার’ নাটক।
আরও পড়ুন
বিভূতিভূষণের ডায়েরির কয়েকটি পাতা এবং ‘আরণ্যক’-এর গল্প
১৯৫১ সালে ছাড়া পেলেন ঠিকই, তবে জীবন আরো অনিশ্চিত। চাকরি নেই, পার্টি দূরত্ব বজায় রাখছে। এখন বাঁচবেন কীভাবে? সেদিন তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন চটকলের শ্রমিকরাই। নারায়ণ মিস্ত্রি নামের একজন রোজ দুধ-মুড়ির জোগান দিতেন। হরিসূদন প্রসাদ দিয়ে গেলেন একটি পুরনো সেলাই মেশিন। আপাতত বাঁচার উপায় হল তাঁদের। বিষ গলাধঃকরণ করতে করতেও মানুষের ভালোবাসার অমৃত তাঁকে জীবনের প্রতি আশা দিয়ে গেল আরেকবার। পরের বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস ‘বি টি রোডের ধারে’।
সদ্য তখন ভোটপর্ব সমাপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিক হিংসার শিকার হতে হয়েছিল তাঁকে। সেই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করার জন্য স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন ছিল ছদ্মনামের। ‘কালকূট’ আশ্রয় করেই প্রকাশিত হয় ‘ভোটদর্পণ’ নামের একটি লেখা। ১৯৫৪ সালে এল আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সাগরময় ঘোষের প্রস্তাব। এলাহাবাদে গিয়ে কুম্ভমেলার বিবরণী পাঠাতে হবে। কিন্তু স্বনামে নয়, অমৃতের সন্ধানেই যখন চলেছেন, তখন তার আদর্শ ছদ্মনাম তো আগেই নির্বাচিত করে রেখেছেন তিনি। ‘কালকূট’ নামে লেখার অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখলেন, “যদি আমার বিষবাহী প্রাণের অমৃত সন্ধানের কথা দেশ পত্রিকাতে একটু বিস্তৃত করে লেখবার অনুমতি দেন।” পেলেন অনুমতি। ঘটনার বিবরণী নয়, আপনমনের মাধুরী মিশিয়ে ‘ট্রাভেলগ’ জাতীয় ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হতে লাগল ‘দেশ’-এ। সমরেশ বসু লিখছেন, “শুরু হল যাত্রা, ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’। কালকূট তাঁর নামের সংজ্ঞার্থ খুঁজে পাচ্ছে।”
মানুষ আর মানুষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার-হাজার লোক জড়ো হয়েছে এখানে। সেই ছোটোবেলা থেকে যেন এই মহামিলনের অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি। পুরনো ঢাকায় মনসুর, ইসমাইলদের হাত ধরে শুরু। আর আজ এক নতুন যাত্রা শুরু হল কুম্ভমেলায় এসে। ধর্মান্ধতার উদযাপন? কালকূট লিখছেন, “লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি ধর্মান্ধ হয়, তবে খুঁজেই দেখি না কেন, লক্ষ মনের কোন চোখে পরানো আছে সেই ঠুলি?” সেই বিচিত্র মানুষ দেখে জীবনের সাধ মিটিয়েছিলেন তিনি।
এরপর ‘কালকূট’-এর নামে প্রকাশিত হয়েছে ‘খুঁজে ফিরি সেই মানুষ’, ‘কোথায় পাবো তারে’, ‘মুক্ত বেণীর উজানে’, ‘চলো মন রূপনগরে’ ইত্যাদি রচনা। এই তালিকা আরো বাড়িয়ে তোলা যায়। ভাষাভঙ্গিতে, প্রকৃতির রূপচিত্রণে, মানবচরিত্র বর্ণনায় প্রতিটি রচনায় ভিন্ন, কিন্তু মর্মে একটি বাণী এক রয়ে গেছে প্রথম থেকেই। পূর্ববঙ্গের মাঠে-ঘাটে শুনেছিলেন লালনের গান, ‘বাড়ির কাছে আরশীনগর’। লালন যখন বলেন, ‘আমার ঘরের কাছে আরশীনগরে এক পড়শী বসত করে’, কিন্তু একদিনও দেখা হয় না তার সঙ্গে। তখন এই যেন আফসোস সমরেশ বসুরও। আরশীনগর তাঁর দেহ, পড়শী সাধক সত্তা। তিনিও চেয়েছিলেন মানুষের কথা বলতে, মানুষের সঙ্গে মিশতে। কিন্তু তিনি তো সাধক নন। বিষ গ্রহণের শক্তি তিনি পাননি। তাই মানুষের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন বারবার। কখনও রাজনীতিতে, কখনও ধর্মীয় স্থানে। খুঁজে ফেরেন অমৃতকুম্ভ।
ঋণস্বীকার : 'গাহে অচিন পাখি', কালকূট, 'কালকূট রচনা সমগ্র'
অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, কালকূট
Powered by Froala Editor