মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ছেড়ে দিয়েছিলেন কবিতা লেখা। ১৪ বছরের কবিতাজীবন, তার মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ। যে বয়সে অনেক কবিই খ্যাতির মধ্যগগনে পৌঁছোন, সে বয়সেই কবিতার সমস্ত পাট চুকিয়ে দিলেন তিনি। কখনও স্পষ্ট করে বলেননি স্বেচ্ছাবসরের কারণ। বড়োজোর বলতেন, “ঢের হয়েছে, থাক”। আসলে, সমর সেন (Samar Sen) মানুষটাই এরকম। অন্তর্মুখী, নির্জনতাপ্রিয়। আবার একই সঙ্গে সৎ, সাহসী আর স্পষ্টবাদী। শুধু কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি নয়। ‘ফ্রন্টিয়ার’ (Frontier) পত্রিকার সম্পাদক সমর সেন ঋজু মেরুদণ্ডের পরিচয় রেখেছেন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। কলকাতার রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোরা পল্টনের দল। একে যুদ্ধের বাজার, তার উপর আবার লাগামহীন ক্ষমতা তাদের হাতে। রাস্তাঘাটে একটু সাবধানেই চলাফেরা করে লোকজন, পারতপক্ষে ছায়া মারায় না তাদের। চৌরঙ্গী চত্বরে একদিন সমর সেনকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে গেল এক গোরা সৈন্য। আর পাঁচজন হলে হয়তো সরে আসত মাথা নিচু করে। কিন্তু তিনি অকুতোভয়ী। এমনিতে রোগা, হাড় জিরজিরে চেহারা হলেও একসময়ে নাকি ছিলেন বাগবাজারের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। হনহন করে সামনে এগিয়ে ইচ্ছে করে সেই সৈন্যটির গায়ে দিলেন এক ধাক্কা। পিছনে ফিরে রুষ্ট গলায় সে জিজ্ঞেস করল, “হোয়াট ডু ইউ মিন?” ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন সমর সেনও, “হোয়াট ডিড ইউ মিন?” ঘটনা আর বেশিদূর এগোয়নি। এক রোগা বাঙালির চোখের আগুন দেখে কথা না বাড়িয়ে নিজের পথে এগিয়ে যায় সৈন্যটি। কিন্তু যদি সত্যিই আক্রমণ করত সে? যতই বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হন না কেন, ওই দশাসই চেহারার সঙ্গে পেরে ওঠা ছিল অসম্ভব। স্পষ্ট উত্তর তাঁর, “অন্তত এক হাত লড়ে তো যেতাম; মার খেলেও অপমান গিলতে হতো না।”
এই সাহস নিশ্চয়ই বক্সিং শিখে আসেনি, এ সমর সেনের মজ্জাগত। তাঁর নিজস্ব অর্জন। সাংবাদিকতার সূত্রে যা কিছু মনে হয়েছে যোগ্য, যা সৎ, তার জন্য লড়ে গেছেন শেষ পর্যন্ত। নতজানু হননি কখনও, রফা করতে শেখেননি। তা হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে কাজের সময় হোক বা ‘নাও’, ‘ফ্রন্টিয়ার’-এর যুগে। সম্পাদক জীবনের প্রথম থেকেই বেশ নামডাক হয় তাঁর। দিব্যি বেড়ে যায় ইংরেজি সংবাদপত্রটির কাটতি। পত্রিকার মালিক আবার দিল্লিমহলের খুব ঘনিষ্ঠ। তাঁর লেখাও প্রায়ই ছাপা হয় পত্রিকায়। কিন্তু ব্যতিক্রম হল একবার। কী ব্যাপার? মালিকের ফোনের উত্তরে সম্পাদকের জবাব, “ছাপাবার মতো হয়নি।” সন্ধের পর সমর সেনের একটু মদ্যপানের অভ্যেস আছে বলে তখন আর তাঁকে ঘাটালেন না। পরদিন সকালে ফের টেলিফোন। ‘প্রকৃতস্থ’ অবস্থায় লেখাটি নিয়ে মতামত বদলেছে কিনা জানতে চান তিনি। অম্লানবদনে সমর সেন জানালেন, “অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় তবু পড়া যায়, প্রকৃতিস্থ অবস্থাও তাও কঠিন।”
এরকম স্পষ্টবক্তা যে কর্মক্ষেত্রে ‘উন্নতি’ করতে পারবে না, সেটা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। রাশিয়ায় অনুবাদকের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন বহু বছর হল, কলমে নেই কবিতার আখর। একবছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন হুমায়ুন কবিরের ‘নাও’ পত্রিকায়। মুশকিল সেখানেও। যে নামই পাঠান না কেন, ডিক্লারেশনের জন্য কোনো নামই নির্বাচিত হয় না। ঠিক হল শেষ চেষ্টায় পাঠানো হবে ‘নাও ওর নেভার’। নির্বাচিত হয়ে ফিরে এল শুধু ‘নাও’। অবশ্য হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে কাজে ছেদ পড়ল এখানেও। ১৯৬৭-এ চালু হল ‘ফ্রন্টিয়ার’। অর্থলগ্নিকারী নেই, হাত পাতবেন না কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে। ভাই আর বন্ধুদের অর্থে সাহায্য চালু হল সাপ্তাহিক পত্রিকাটি। যার চেহারাও সম্পাদকের মতোই, ক্ষীণকায়। কিন্তু আদর্শের আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। বামপন্থী ভাবধারা বজায় রাখলেও ঝুঁকে পড়েনি কোনো রাজনৈতিক দলের ক্যাঙারুর কোলে। সেই নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তও হয়েছে শাসকপক্ষ। এমনকি এমার্জেন্সির সময়ে নিষিদ্ধ পর্যন্ত করা হয় পত্রিকাটিকে। রাজ্যে বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও বন্ধ থাকেনি সমালোচনার ধারা। সব প্রত্যাশা কি পূরণ করতে পেরেছিল বাম সরকার? প্রশ্নের পর প্রশ্নে খোঁজা হয়েছে সমস্যার গভীরতর কারণ।
আরও পড়ুন
‘অরূপকথাগামী’ বিনয় মজুমদারের কবিতা
সত্যের জন্য পক্ষ নেওয়ার সুশীতল ছায়াতল অবজ্ঞা করেছিলেন আমৃত্যু। শেষ জীবনে ঘিরে ধরেছিল চূড়ান্ত অর্থাভাব আর আত্মীয় বিয়োগের দুঃখ। তখনও দীর্ঘ রোগশয্যাতে ‘ফ্রন্টিয়ার’-কে নিয়ে বুনছেন অসংখ্য স্বপ্ন। পিজি হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থাতেও কথা বলে চলেছেন একটা বিষয় নিয়েই, “কয়েক সপ্তাহ ফ্রন্টিয়ারের কাজকর্ম একদম দেখতে পারিনি, কী হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই জানি না।” সে যাত্রায় সুস্থ হয়ে ফিরলেও, মৃত্যু যেন তাঁর কাছে সামান্য একটু ‘অসুবিধা’। তখনও রক্তে এক হাতে লড়ে যাওয়ার স্পর্ধা। কেউ বলতেন ‘সিনিক’, কেউ-বা অস্থিরচিত্ত। আসলে তো চেয়েছেন একান্ত নির্জনতায় সৎ থাকতে। কবিতা, সাংবাদিকতা আর জীবন সবই যেন সেই এক সুতোয় গাঁথা।
আরও পড়ুন
‘ঢের হয়েছে’, মাত্র ৩৮ বছর বয়সেই কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন সমর সেন
ঋণস্বীকার : সমর সেন বিশেষ সংখ্যা, অনুষ্টুপ
Powered by Froala Editor