১ মে, ১৯০৮ সাল। ভোর তখন পাঁচটা। কলকাতার গ্রে স্ট্রিটের একটি বাড়িকে আচমকা ঘিরে ফেলে সশস্ত্র ইংরেজ পুলিশ। কী ব্যাপার? ভয়ানক সব বিপ্লবীদের ঠিকানা এখানে। এই বাড়ি থেকেই চলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা। তাহলে হয়তো এই বাড়ির ‘মালিক’ অরবিন্দ ঘোষই (Aurobindo Ghosh) সমস্ত কর্মকাণ্ডের মাথা। আধ্যাত্মবাদের দিকে ঝোঁক থাকলেও ‘বন্দেমাতরম’-এর মতো সোচ্চার পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। লোকমান্য তিলকের মতো তিনিও বেছে নিয়েছেন চরমপন্থী রাজনীতির পথ। এমন দুর্ধর্ষ বিপ্লবীর জীবনযাত্রাও নিশ্চয়ই বিশেষভাবে সুরক্ষিত হবে।
কিন্তু সেদিন ভোরে পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্রেগান সাহেব অরবিন্দের ঘরে ঢুকে বেশ হতবাকই হলেন। ঘরে যেরকম সামান্য আসবাবপত্র, তেমনই সাধারণ আসন্ন বন্দির পোশাক। কথাবার্তাও নম্র, বিনয়ী। বিস্মিত ক্রেগান শেষ পর্যন্ত প্রশ্নই করে বসলেন, “শুনিলাম আপনি বি.এ পাশ করিয়াছেন; এমন বাসায়, এইরূপ আসবাবশূন্য ঘরে মাটিতে শুইয়া থাকা কি আপনার ন্যায় শিক্ষিত লোকের পক্ষে লজ্জার কথা নয়?” উত্তরে অরবিন্দ জানালেন, “আমি গরিব, গরিবের মতই বাস করি।” এত খ্যাতি আর প্রতিপত্তি যাঁর, তিনি কিনা গরিব? মেনেই নিতে পারলেন না ক্রেগান সাহেব। হয়তো ভিতরে কোনো দুরভিসন্ধি আছে। হাতকড়ি পরিয়ে, কোমরে দড়ি দিয়ে ধরে আনার বদলে বেঁধে থানায় নিয়ে যাওয়া হল অরবিন্দ ঘোষকে।
বাড়িতে খানাতল্লাশি চলল ছয় ঘণ্টা ধরে। কিন্তু বোমার সন্ধান মিলল না। যেভাবেই হোক কথা বের করতে হবে অরবিন্দের মুখ থেকে। হাজার কথার মাঝে বেশ সহানুভূতির সুরেই জিজ্ঞেস করলেন এক গোয়েন্দা, “আপনি আপনার ছোটো ভাইকে বোমা তৈরির জন্য বাগানটি ছাড়িয়া দিয়া বুদ্ধিমানের কাজ করেন নাই, খুবই ভুল করিয়াছিলেন।” কথার মারপ্যাঁচ বুঝতে দেরি হল না। পা দেওয়ার জন্য বেশ সূক্ষ্ম করেই পাতা হয়েছে ফাঁদটি। ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন তিনি, “বাগানে আমার ও আমার ভাইয়ের সমান অধিকার; আমি যে তাহাকে বাগানটি ছাড়িয়া দিয়াছি বা ছাড়িয়া দিলেও বোমা তৈরির জন্য ছাড়িয়াছি এমন কথা আপনি কোথায় শুনিলেন?” এই কথার পর আর ধর্ম-দর্শন-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা চলে না।
তবে তিনি কিন্তু প্রতিবারই বোমা মামলার সঙ্গে নিজের যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছিলেন। এই সংক্রান্ত একাধিক ডাকাতির ঘটনা ও হত্যাকাণ্ডের দায় যে তাঁর নয়, তা স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন পুলিশকে। বিশ্বাস ছিল যে তিনি ‘নির্দোষ’ প্রমাণিত হবেন। সেই প্রমাণের লড়াই চলল এক বছর ধরে। তাঁর পক্ষে আইনি লড়াই করলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯০৯ সালের ৫ মে অরবিন্দের কারাবাস শেষ হয়। ইতিমধ্যে আলিপুর বোমা মামলায় বারীন ঘোষ প্রমুখদের দ্বীপান্তরের সাজা হয়েছে। জেলের মধ্যে ঘটে গেছে নরেন গোঁসাই হত্যাকাণ্ড। ফাঁসিতে জীবন দিয়েছেন কানাইলাল দত্ত। আর এদিকে একটু একটু করে নিজেকে ধর্মপথের দিকে সরিয়ে নিচ্ছেন অরবিন্দ। যে সাধনা শুরু হয়েছিল বছর কয়েক আগেই। জেলের অখণ্ড সময়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জীবন ফেলে তিনি মুক্তি খুঁজলেন সাধনমার্গে। একটা ছোটো ঘর। বর্ষায় জলে ভরে যেত ঘরখানি। সেখানেই চলল একাকী জীবনযাপন।
আরও পড়ুন
কারাবন্দি অরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর ‘কৃষ্ণপ্রাপ্তি’
অবশ্য এর আগেও কৃচ্ছসাধন করতে হয়েছে তাঁকে। কর্মসূত্রে বরোদা থাকাকালীন একটি সাধারণ লোহার খাটে কম্বলের আশ্রয়ে শীতের দিন কাটিয়েছেন তিনি। আবার প্লেগের বিপদের সময় শহর থেকে দূরে পরিত্যক্ত বাড়িতে মশা-মাছির সঙ্গেও ঘর-সংসার ছিল তাঁর। কে বলবে তিনি কলকাতার বিখ্যাত ধনী কৃষ্ণধন ঘোষের সন্তান? যাঁর কৈশোরের একটা বড়ো সময় কেটেছে বিদেশে। পিতার সাহেবপ্রীতি এতটাই অধিক ছিল যে প্রথমে সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘অ্যাক্ররয়েড’। পারিবারিক সূত্রে উদার মানসিকতা পেলেও, অর্থের মূল্য বুঝতেন অরবিন্দ। বেছে নিয়েছিলেন ‘সাধারণ’ জীবনপদ্ধতি। গীতাপাঠের মধ্যে খুঁজে নিতেন জাগতিক কর্মকাণ্ডের ঊর্ধ্বে ওঠার নিগূঢ় সাধনা।
আরও পড়ুন
বাবার দেওয়া নাম ‘অ্যাক্রয়েড’, যৌবনে পৌঁছে প্রথম বাংলা শেখেন ‘সাহেব’ অরবিন্দ ঘোষ
বাংলায় যখন ফিরলেন, তখন এখানের অবস্থা অগ্নিগর্ভ। বঙ্গভঙ্গের আগুনের মধ্যে থেকে ‘অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী’। এবার মরা গাঙে বান এসেছে, এখন ‘জয় মা’ বলে তরী ভাসানোর সময়। জাতীয় শিক্ষাপরিষদের সঙ্গে কিছুদিন যুক্ত থাকলেও মতবিরোধের জন্য বেরিয়ে আসেন সেখান থেকে। শুরু হল ‘বন্দেমাতরম’-এর পর্ব। ‘নরমপন্থী’-দের আবেদন-নিবেদনের প্রথা থেকে সরে ডাক দিলেন স্বাধীনতার। তার জন্য দেশবাসীকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। প্রয়োজনে সশস্ত্র হবে তার পথ। বিপিনচন্দ্র পাল, বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায় প্রমুখের সঙ্গে অরবিন্দও খ্যাত হলেন ‘চরমপন্থী’ রূপে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বাঁক নিল নতুন দিকে।
কারাবাস পরবর্তী জীবনে অরবিন্দ বেছে নিয়েছিলেন আধ্যাত্ম সাধনার পথ। তাঁর মত ও পথ পরিবর্তন নিয়ে চর্চা হতেই পারে, কিন্তু স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ছিল প্রশ্নাতীত। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে চিঠিতে লিখেছিলেন, “আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি।” এই চিঠিগুলি তাঁকে গ্রেপ্তারকালে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতেও ব্যবহার করা হয়। ব্যক্তিগত পত্র ধরে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল অরবিন্দের রাজনৈতিক মতবাদ। তাঁর একটিতে তিনি লিখছেন, “আমি জানি এই পতিত জাতিকে উদ্ধার করিবার বল আমার পায়ে আছে।” এগুলি লেখা হয়েছে গ্রেপ্তার হওয়ার অন্তত এক বছর আগে। তখন থেকেই একটা পরিবর্তনের ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন ভিতরে। যেন মনে হচ্ছিল, “আমি আর নিজের ইচ্ছাধীন নই, যেইখানে ভগবান আমাকে নিয়া যাইবেন, সেইখানে পুতুলের মত যাইতে হইবে।”
জেলযাত্রা ‘ভগবান’-এর ইচ্ছাধীন কিনা জানা নেই। কিন্তু এক বছর আগে লেখা ব্যক্তিগত পত্রে নিশ্চয়ই মিথ্যাচার করবেন না তিনি? পথ বেঁকে গেছিল আগেই। জীবনের দুপ্রান্তের মাঝে ইতিহাসের ভরকেন্দ্র হয়ে রয়ে গেল আলিপুর বোমা মামলা। কারামুক্ত অরবিন্দ ফিরে গেলেন না সংগ্রামী জীবনে। চিঠির বক্তব্যের মতোই ‘তরবারি বা বন্দুকের নিয়া আমি যুদ্ধ করিতে যাইতেছি না, জ্ঞানের বল’ সহকারে পাড়ি দিলেন পণ্ডিচেরি। পিছনে পড়ে রইল বাংলা, ভারতবর্ষ, স্বাধীনতা। ‘বিপ্লবী’ অরবিন্দ পরিণত হলেন ‘ঋষি’ অরবিন্দে।
ঋণস্বীকার : শ্রীঅরবিন্দ, ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor