আঠারো শতক বাংলার সমাজ-রাজনীতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক সন্ধিক্ষণের সময়। নবাবি আমল শেষপ্রান্তে, ইংরেজ বণিকের মানদণ্ড ক্রমে পরিণত হচ্ছে রাজদণ্ডে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগও শেষ হওয়ার পথে। সংস্কৃত কাব্যের অনুবাদ, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলির ধারাস্রোত শুকিয়ে গেছে অনেকটাই। ‘যাবনী মিশাল’ ভাষায় কাব্য লিখছেন ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। শক্তিসাধনার রীতি বাংলায় বহুযুগ ধরে প্রচলিত থাকলেও যথার্থভাবে ‘শাক্ত পদাবলী’-র জনপ্রিয়তার সূত্রপাত এই সময় থেকেই। মূলত রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের গানের সুরে বাঙালি ডুব দিচ্ছে ‘কালী’ বলে।
কবি রামপ্রসাদ সেনের জন্ম আনুমানিক ১৭২০ সালে, উত্তর চব্বিশ পরগণার হালিশহরে। কলকাতার এক জমিদারের বাড়িতে মুহুরির কাজও করেছিলেন কিছুকাল। প্রচলিত যে, জমিদারের সেরেস্তার খাতায় ‘আমায় দাও না তবিলদারী’ গানটি লিখে কর্মচ্যুত হন তিনি। অর্থের ব্যাপারে উদাসীন কবির আর্থিক দুরবস্থা মেটেনি কোনোদিন। স্বয়ং মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন তাঁর গানের ভক্ত। রামপ্রসাদকে নিয়ে কিংবদন্তির সংখ্যাও কম নয়। তবে সেসব ছাপিয়ে অমরত্বের সন্ধান খুঁজে নিয়েছে রামপ্রসাদী গানের সরল-প্রাণভোলানো আকুতি। আদ্যাশক্তি তাঁর কাছে জননীস্বরূপ, মান-অভিমানের আশ্রয়। মাটির পৃথিবীর ধুলোমাখা শরীরের সঙ্গে মিশে যায় বাৎসল্যরসের আধ্যাত্মিক চেতনা।
তুলনায় তাঁর ‘আগমনী-বিজয়া’ পর্যায়ের গানের সংখ্যা কম। সেখানে অনেক বেশি কৃতিত্ব কমলাকান্তের। দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের চিরাচরিত পৌরাণিক কাহিনি ও বাঙালি মেয়ের ‘বাপের বাড়ি’ ফেরার আকাঙ্ক্ষাকে ধরে রাখে ‘আগমনী’ পর্যায়ের গান। পার্বতীর মা মেনকা স্বামীকে হিমালয়কে অনুরোধ করেন দরিদ্র স্বামীর ঘর থেকে কন্যাকে নিজগৃহে নিয়ে আসার। তিনদিন মর্ত্যে বসবাসের পর পার্বতী ফিরে যান শিবের কাছে। তখন বিষাদের সুরে ভিজে ওঠে ‘বিজয়া’ পর্যায়ের গান। বৈষ্ণব গীতিকবিতার বাৎসল্যরসের মতো শুধু ‘বৈকুণ্ঠের গান’ নয়, সত্যিকারের বাঙালি ঘরের আনন্দ-দুঃখের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে এখানে। রামপ্রসাদের গানে ঐশ্বর্যময়ী জগজ্জননী বাঁধা পড়েন পারিবারিক বন্ধনে।
কীরকম তার প্রকাশ? নগরে পড়ে গেছে কোলাহল, গৌরী ফিরছেন আজ। জয়া এসে খবর দিয়েছেন মা মেনকাকে। বারবার গিয়ে দেখেন কত দূরে রয়েছেন তাঁর কন্যা। অবশেষে রথ থেকে নেমে মাকে প্রণাম করেন তিনি। বরণ করতে ছুটে যান মা। আজ ‘শুভনিশি’। পোশাক অবিন্যস্ত, আর তর সইছে না তাঁর। কোলে বসিয়ে শুধু দেখতে থাকেন মেয়ের মুখ। চোখে জল ঝরে, অক্লান্ত চুম্বনে ভরিয়ে দেন তাঁকে। আর সঙ্গে হাজার অনুযোগ, উচিত হয়নি এরকম ‘জনম-ভিখারী’, ‘দিগম্বর’-এর ঘরে কন্যার বিবাহ দেওয়া। সখীকে কাছে পেয়ে সহচরীদের মনও আনন্দিত। তাঁরা বলছেন,
আরও পড়ুন
‘কবিতার দেশ’-এ দুর্গাপুজো ও প্রবাসী বাঙালির মুখরতা
“বৎসরেক ছিলে ভুলে,
এত প্রেম কোথা খুলে,
কথা কহ মুখ তুলে, প্রাণ মরে মরে।”
আরও পড়ুন
১৮৩ বছরে রামকৃষ্ণ-স্মৃতিধন্য কুমোরটুলির গঙ্গাপ্রসাদ ভবনের দুর্গাপুজো
আর এই সব কিছু দেখে মনে মনে হাসছেন রামপ্রসাদ। তাহলে বুঝি এরকমই হয় আনন্দসাগরে ভেসে যাওয়ার সুখ?
আরেকটি বহুল প্রচলিত পদে ধরা পড়ে এক আবেগঘন সংকল্প। হিমালয়কে বলছেন, এবার উমা এলে আর ফিরে যেতে দেবেন না তাঁকে। লোকে মন্দ বললেও আর শুনবেন না। কিন্তু যদি শিব এসে উমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন, তবে?
“এবার মায়ে ঝিয়ে করবো ঝগড়া
জামাই বলে মানবো না।”
রামপ্রসাদও সমর্থন করছেন তাঁকে। এই দুঃখ তো আর সহ্য করা যায় না। শিব সারাদিন শ্মশানে-মশানে পড়ে থাকেন, ঘরের কথা একেবারেই ভাবেন না। কোন মা পারে এমন স্বামীর কাছে আবার মেয়েকে পাঠাতে?
কিন্তু সত্যিই দ্বারে এসে উপস্থিত হন ‘মহাকাল’। “বেরোও গণেশ-মাতা ডাকে বার বার।।” মুখে যাই বলুন না কেন, ঝগড়া করার শক্তি পান না মেনকা। মেয়েকে বিদায় দিতে হবে, এই ভয়ে কাঁপতে থাকে সর্বাঙ্গ। বিধাতার কী নিষ্ঠুর শাস্তি! ‘তনয়া পরের ধন’ জেনেও দুদিনের জন্য এই সুখ দেওয়ার কী দরকার ছিল? ‘হিমগিরি রাজরাণী’-ও আজ নিঃস্ব মনে করেন নিজেকে।
এ তো নিছক পুরাণের গল্প নয়, বাঙালি মায়ের শ্বাশ্বত আর্তি লুকিয়ে এর মধ্যে। রামপ্রসাদের গান তত্ত্বের বাঁধন ছিন্ন করে বলতে থাকে ঘরের গল্প। চিরপরিচিত জীবনের গল্প। যুগের পর যুগ কেটে গেলেও পুরনো হয় না মহিমা। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে ঘরে ফিরে আসতে চায় বাঙালি মন। যা কিছু বাঙালির নিজের, যা কিছু শিকড়ের কাছের, রামপ্রসাদের গান জড়িয়ে থাকে তার সঙ্গে।
Powered by Froala Editor