জেনেটিক্স থেকে প্রযুক্তিবিদ্যা, সবেতেই অবাধ বিচরণ রথীন্দ্রনাথের

মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হয় ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন চোদ্দো বছর। পরদিন ডাক এল রবীন্দ্রনাথের থেকে। স্ত্রীর একজোড়া জুতো পুত্রের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এটা তোর কাছে রেখে দিস। তোকে দিলুম।” পিতার আদেশ মান্য করে জুতোজোড়া সযত্নে রক্ষা করলেন রথীন্দ্রনাথ। শুধু মাতৃস্মৃতি বলে নয়, কৈশোরেই বুঝেছিলেন এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব। তখনও বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা হয়নি। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসদনে সংরক্ষিত করলেন অত্যন্ত ব্যক্তিগত এই স্মারক। বস্তুত রবীন্দ্রসদন তথা বিশ্বভারতীর সংগ্রহশালার প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rathindranath Tagore)। 

তাঁর জীবনের সাধনা বড়ো নীরব, অথচ অত্যন্ত গভীরতার সঙ্গে সুসম্পন্ন করতেন বরাদ্দ কাজ। শান্তিনিকেতনের গৃহনির্মাণের পরিকল্পনা থেকে শিল্প-প্রযুক্তির সাধনা, সর্বত্রই কাজ করেছেন অদ্ভুত সচল নীরবতায়। কোথাও কোনো প্রচারভঙ্গিমা নেই, কিন্তু প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে চোখে পড়বে ভালোবাসার নমুনা। পৃথিবীর যে প্রান্তেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত খবর প্রকাশিত হোক, তা সংগ্রহের ব্যবস্থা করতেন তিনি। সেই পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন সদ্যযৌবনেই। ঠাকুরবাড়ির চিরাচরিত শিল্প-প্রতিভার সঙ্গে মিশেছিল বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিগত শিক্ষা। বহুমুখী গুণের অধিকারী, বিখ্যাত হতে পারতেন একাধিক ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম। বলতেন, “জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের; কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের।”

তবে যে কাজই করেছেন, সেখানেই প্রতিভার চূড়ান্ত নমুনা রেখেছেন। ১৯০৯ সালে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিজ্ঞানের পড়াশোনা শেষ করেন। জোড়াসাঁকোয় তখন গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথদের হাত ধরে শুরু হয়েছে শিল্পচর্চার নতুন ধারা। গ্রামজীবনের লোকসংস্কৃতির সংরক্ষণ নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথও। রথীন্দ্রনাথ হাত লাগালেন চারুশিল্প ও দারুশিল্পের কাজে। পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে গড়ে তোলেন ‘বিচিত্রা কারুসংঘ’। কাঠের কাজের বিভিন্ন পদ্ধতির পাশাপাশি চামড়া, সেরামিক ও পটারি শিল্প, বয়ন শিল্পে সার্থক মিশ্রণ ঘটালেন প্রচলিত শিল্পধারা ও লোকশিল্পের। আবার রবীন্দ্রনাথের স্বদেশিভাবনাকে মাথায় রেখেই শ্রীনিকেতনে বিদ্যুৎ চালিত মেশিন ও কাঠচেরাইয়ের কাজের ব্যবস্থা করেন রথীন্দ্রনাথ। 

উত্তরায়ণ পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও উদ্যোগী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব পরিবেশচিন্তাকে রূপ দিলেন রথীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্র কর। ঠাকুরবাড়ির প্রথাগত যে স্থাপত্যশৈলী অনুসৃত হয়ে আসছে দেবেন্দ্রনাথের সময় থেকে, তার সঙ্গে যুক্ত হল প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যের নিদর্শন। শুধু বাড়ির বহির্বিভাগে নয়, ভিতরের আসবাবপত্রেও চোখে পড়বে তাঁর গভীর শিল্পচেতনা। ১৯২৩ সাল নাগাদ পোরবন্দর থেকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে পুত্রকে লিখছেন ফার্নিচার কারখানা খোলার কথা। নেহাৎ শৌখিনতা নয়। যদি এদিককার কোনো রাজা শান্তিনিকেতনের শিল্পকলা অনুযায়ী ঘর সাজানো শুরু করে, তাহলে কলাভবনের আদর্শ সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। জীবনযাত্রায় রুচির ফাঁক পড়ুক, কোনোভাবেই চাননি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কাছে রথীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, প্রতিমা দেবীর মতো শিল্পীরাও ছিলেন। শ্রীনিকেতনের পল্লীগঠনের কাজের ফাঁকে সকলে মিলে মেতে উঠলেন ‘ফার্নিচার কারখানা’-র কাজে। যার প্রধানতম কর্ণধার ছিলেন রথীন্দ্রনাথ।

আরও পড়ুন
বিপ্লবী আন্দোলন নিয়ে বই লিখে রাজরোষে ঠাকুরবাড়ির সৌমেন্দ্রনাথ

তার কিছু বছর আগে থেকেই বিশ্বভারতীতে জেনেটিকস পড়ানোর দায়িত্ব নেন তিনি। প্রকৃতিবিদ্যার গতানুগতিক ধরনের বদল আনলেন আশ্রমের পাঠ্যক্রমে। উত্তরায়ণের বাগানে চলল ছাত্র-শিক্ষকদের হাতে-কলমে শিক্ষা। বোলপুরের কঠিন ভূমিকে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল রথীন্দ্রনাথের। পাশাপাশি উত্তরায়ণেই গড়ে উঠেছিল তাঁর প্রযুক্তিচর্চার একান্ত কর্মশালা। অথচ, আজও বিশ্বভারতীর খ্যাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরিখেই সীমাবদ্ধ। শ্রীনিকেতন-কলাভবনকে সামনে রেখে দেশের প্রযুক্তি ও শিল্পচেতনায় এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্ত খুলেছিল, তার স্বীকৃতি মিলল কোথায়? হয়তো তাকে কাজে লাগানোর সদিচ্ছার অভাবের জন্যই।

আরও পড়ুন
বাগানবাড়িতে বিলাসিতায় মত্ত দ্বারকানাথ ঠাকুর, ঘৃণায় ছেড়ে যেতে চাইলেন স্ত্রী দিগম্বরী

এ তো গেল কৃষিবিদ, প্রযুক্তিবিদ রথীন্দ্রনাথের কথা। যিনি অত্যন্ত নীরবে কাজ করে গেছেন শান্তিনিকেতনের উন্নতিকর্মে। উপাচার্যের পদ সামলেছেন, অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ অনুবাদ করেছেন। ইংরেজি ও বাংলা, উভয় ভাষাতেই ছিল স্বাভাবিক দখল। আবার পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মধ্যে অযাচিত এক দূরত্ব নিয়েও শোনা যায় কত কথা। তখন সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে ভারত। রথীন্দ্রনাথ ছুটে গেলেন দিল্লিতে। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে কথা বললেন, যাতে ‘জন গণ মন অধিনায়ক’-কে জাতীয় সংগীত করা হয়। মিতভাষী মানুষটি কিন্তু সেদিন কার্যোদ্ধার করেই ফিরেছিলেন।

১৯৬১ সালের ৩ জুন প্রয়াণ ঘটে রথীন্দ্রনাথের। আর সে বছর রবীন্দ্রনাথের জন্মের শতবর্ষ। দেশে তো বটেই, বিদেশেও আয়োজন চলছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। মৈত্রেয়ী দেবী, সমর সেন প্রমুখ তখন রাশিয়াতে। সেখানে এসে পৌঁছোল রথীন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর। “পোয়েট’স সন ইজ ডেড”, এভাবেই শোকসংবাদ জানালেন এক ভারতীয়। ‘কবিপুত্র’, এই পরিচয়ই জীবনের প্রায় সব অধ্যায়ে বহন করে যেতে হয়েছে তাঁকে। ছাড় মেলেনি মৃত্যুর পরেও। দিনের সব তারার মতো রথীন্দ্রনাথও ঢাকা পড়েছিলেন রবির আলোর দাপটে। 

ঋণস্বীকার : রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জন্মশতবর্ষপূর্তি-শ্রদ্ধার্ঘ্য, বিশ্বভারতী

Powered by Froala Editor