‘চন্দনের ধূপে পোড়া কুশপুতুল’ এবং অলোকরঞ্জনের ঈশ্বর

“ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়েই আমি বেঁচে আছি। মার্কসবাদ বা অন্যান্য আধুনিক মতবাদের প্রতি আমার দুর্বলতা সত্ত্বেও ঈশ্বরবিশ্বাসই আমার অস্তিত্বের ভিত্তি।... ঈশ্বর আজকে, আপনারা দেখবেন প্রতিটি বিপ্লবের মধ্যেই ঈশ্বর জড়িত, কীভাবে? না, গোপন আন্দোলনের মতো—আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্টের মতো।”

কী করে দুটিকে মেলান অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (Alokeranjan Dasugupta)? এ তো ‘ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ির দরজা’ নয়, এখানে একদিকে দাঁড়িয়ে প্রবল ঈশ্বরবিশ্বাস আর অন্যদিকে লাতিন আমেরিকা, ভিয়েতনামের বিপ্লব। ঈশ্বর নিশ্চয়ই মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে অস্ত্র তুলে দেন না তাদের হাতে। কিংবা জাদুবলে উড়িয়ে দেন না শত্রুদের। তবে? অলোকরঞ্জন বিশ্বাস করেন, আজ আর প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বর বলে কিছু হয় না। ততদিনে প্রথম জীবনের ‘যৌবনবাউল’ কাব্যগ্রন্থের বিশ্বাস থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন তিনি। এই চলমানতায় ঈশ্বরকে গোপন প্রেমিকের মতো আগলে রাখার জন্যই তাঁর কবিতাযাপন, তাঁর শুদ্ধতার সাধনা।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রথম মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ‘যৌবনবাউল’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। তখন ফুরিয়ে এসেছে চারের দশকের উত্তাল দিনগুলির রেশ। সময় এখন বড্ড বেশি সংশয়ী। সমাজচেতনা নেই বলা যাবে না, তবে মূল চেষ্টা জীবনের মধ্যে তার রূপ আত্মস্থ করার অনুশীলনের মধ্যে। নিজেকে খুঁজে দেখা, পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে একটা বিস্ফোরণের উৎকণ্ঠায় মগ্ন ছিল পঞ্চাশের কবিতা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস’ এবং আলোক সরকারের ‘শতভিষা’ পত্রিকা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, তরুণ সান্যাল, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, বিনয় মজুমদার-সহ প্রত্যেক কবিরই ভাষা আর শৈলী আলাদা, তবে সৌন্দর্য্য আর রূপকল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থাকে তাঁদের কবিতা। অলোকরঞ্জন সেখানে এলেন উপলব্ধির বহুস্তর নিয়ে। যার মধ্যে অবশ্যই পড়বে তাঁর স্বঘোষিত ঈশ্বরচেতনা। যা হয়তো সমসময়ের আর কোনো কবির মধ্যেই সেভাবে চোখে পড়বে না।

কীরকম? আধিদৈবিক কোনো আশীর্বাদ নয়, রোজকার জীবনের হাঁটাচলায় সন্ধান করেন জীবনাদর্শ। উপনিষদ পাঠ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় বিশ্বাস তাঁকে স্বতন্ত্র পথ দিয়েছিল। যে ভাঙাগড়ার খেলায় গোটা দশক ডুবে ছিল, তার মধ্যে যেন এক দ্বীপ স্থিরতা। ‘কৃত্তিবাস’ আর ‘শতভিষা’-র সঙ্গে থেকেও তিনি আলাদা। সহযাত্রী কবিরা কি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ভাবনায়। তাই কি তিনি লেখেন,
“বন্ধুরা বিদ্রুপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে;
তোমার চেয়েও তারা বিশ্বাসের উপযোগী হলে
আমি কি তোমার কাছে আসতাম ভুলেও কখনো?”

আরও পড়ুন
‘অরূপকথাগামী’ বিনয় মজুমদারের কবিতা

একই সঙ্গে এখানে আছে নাগরিকতা থেকে মুক্তির স্বাদ। শান্তিনিকেতনের পথে-প্রান্তরের বহু স্মৃতি মিশে আছে বাউলের শরীরে। সেখানেও কোনো কাঠুরের ছদ্মবেশে ঈশ্বর নেমে আসার অনুভূতি পান তিনি। কিংবা মেঘের সাঁকোর ‘নিথর শূন্য’-এ আচমকা মিলিয়ে যেতে দেখেন ঈশ্বরকে। 

আরও পড়ুন
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতার ‘অগভীর’ দুঃখবাদের সন্ধানে

আধ্যাত্মিকতা বা ভক্তিবাদ নয়, এ বিশ্বাস অলোকরঞ্জনের নিজস্ব, বাংলা কবিতার নিজস্ব। রবীন্দ্রনাথের মতো ‘জীবনদেবতা’ নয় বা অমিয় চক্রবর্তীর মতো আত্মগত নয়। বরং প্রতিষ্ঠান থেকে নেমে আসা এক দামাল প্রেমিক বা প্রেমিকা। যাঁকে তিনি পেয়েছেন ‘উত্তরাধিকার সূত্রে’। এই বিশ্বাসটা আজীবন স্থির ছিল তাঁর, কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলেছে রূপ। 

‘নিষিদ্ধ কোজাগরী’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে তাই বিভ্রান্ত হয়েছিলেন অনেকেই। যেখানে আঘাত করা হয়েছে ঈশ্বরকে, নষ্ট হয়েছে স্বাভাবিক গাম্ভীর্য। আবার শত আয়োজনের মধ্যে যেভাবে তিনি ঈশ্বরকে হারিয়ে যেতে দেখেছেন, সেই দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে ‘রক্তাক্ত ঝরোখা’-য়। আবারও, অনেকেই হতাশ হন। ভেবে বসেন কবি হয়তো নাস্তিক হয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর বিশ্বাসের পরিচয় মেলে ‘নাম কবিতা’য়।

“বাটিতে আঁকা আকাশে দিনশেষে
তুমি আমার প্রিয়,
রয়েছে যারা তোমার পরিবেশে
তারাও ঈশ্বরীয়”

ততদিনে ঢুকে পড়েছে সাতের দশক। বিশ্বজুড়ে এক টালমাটাল পরিস্থিতি। ঈশ্বর কি তখনও থাকবে মুখ বুজে চুপ করে? অলোকরঞ্জন তখন বিভক্ত জার্মানিতে। তাঁর সেই সময়ের বাংলার কবিতায় জায়গা করে নেয় কিছু আচমকা ইংরেজি শব্দ। ‘ছৌ কাবুকির মুখোশ’-এ ছড়িয়ে আছে এরকম অসংখ্য উদাহরণ। ১৯৭৭-এ প্রকাশিত ‘গিলোটিনে আলপনা’ কাব্যগ্রন্থে ‘ঈশ্বরের ভীষণ মুখোমুখি’ দাঁড়ালেন তিনি। সমস্ত ব্রতকথা অস্বীকার করে টালিগঞ্জের ভিড়ে হেঁটে যান এক সাধিকা, পায়ের আঘাতে ভেঙে যায় পুজোর আয়োজন। এতোই কি ঠুনকো ঈশ্বর আর শক্তির মেলবন্ধন? নাকি আনুষ্ঠানিকতায় মানুষ নিজেই হয়ে উঠতে চায় প্রতিষ্ঠান? এই সময়ে রাজনৈতিকভাবেও কিছুটা বিপর্যস্ত হন অলোকরঞ্জন। সব মিলিয়ে একটা তির্যকতা খুঁজে নেয় তাঁর কবিতা। লেখেন, 

“ফাঁসির মঞ্চে
ঈশ্বরী এক, সকল দেহে স্তন,
শত লক্ষ নারীর যৌথ বিসর্জন
গড়েছে এই ঈশ্বরীকে।”

স্পষ্টতই ‘যৌবনবাউল’-এর সঙ্গে এর মিল নেই কোনো। ক্রমাগত অপমানেও নিথর নীরবতা যেন অলোকরঞ্জনকে তাঁর একপ্রকার প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। চন্দনের ধূপে পুড়ুক তাঁর কুশপুতুল, তবু সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে চান ঈশ্বরকে, মানুষকে। 

একটা সময় তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে ভেঙে যায় বিশ্বাস। আরাধ্যকে প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে আনার সমীকরণ তৈরি করেন। ঈশ্বর হয়ে ওঠেন সমাজবদলের সঙ্গী। তিনি আছেন, তার মধ্যে আছে বিরোধাভাস। অনেক নামেই ডাকা যেতে পারে তাঁর কবিতাকে। সবটাই সত্য, বিচিত্র তার গন্তব্য। আর সেই বিশ্বাসের মধ্যেই খুঁজে নেওয়া যাবে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More