তিনি তখন বন্ডেলের বাসিন্দা। বহু কষ্টে জোগাড় করা গেছে তিলজলার একটি সরকারি আবাসনে মাথা গোঁজার ঠাঁই। বছর পাঁচেক হল অবসর নিয়েছেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ থেকে। অবশ্য পাণ্ডিত্য আর খ্যাতির বিন্দুমাত্র আঁচ পাওয়া যায় না তাঁর আচরণে। প্রায়ই চলে যান বন্ডেল বাজারে, সেখানকার কামার, দর্জি, ছোটোখাটো দোকানদারদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারাও ভালোবাসে খুব। কাঠের বাক্স উলটো করে পেতে দিত লক্ষণ দর্জি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত আড্ডা। আবাসনের অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি ব্যাপারটি। এক ভদ্রলোক তো সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসল লক্ষণ দর্জিকে, কী কথা হয় এত? মতলবটাই বা কী? সহজ ভাষাতেই উত্তর দিয়েছিল লক্ষণ, “ওঁর কাছে অমৃতভাণ্ড আছে। আমরা চেষ্টা করি কোনোরকমে তার থেকে যদি দুয়েকটা ফোঁটা পাই।”
এরকমই ছিলেন কবি অরুণ মিত্র (Arun Mitra)। যিনি ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে যান প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয়ে, যাঁর মুকুটে রয়েছে ফ্রান্সের ‘অর্ডার অফ পালম অ্যাকাডেমিক’-এর সম্মান। তাঁকেই আবার দেখা যায় বন্ডেলের আড্ডায় ‘অমৃতভাণ্ড’ বিতরণ করতে। কিংবা পার্টির মিটিং শেষে ফেরার পথে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রদের সঙ্গে ফাঁকা ট্রামে হইহই করে উঠতে। বাকিরা গান ধরত গলা খুলে, তিনি শুধু শুনতেন চুপ করে। কখনও বা পিছনের সিটের জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে থাকতেন ট্রামের চাকার দিকে। রাতের আঁধারের অস্পষ্ট আলোয় ঘাস দেখতেন। একমাত্র ট্রামে বসেই সবুজ দেখা যায়, বাকি সব কিছু ঢেকে গেছে ইট-কাঠের ইমারতে। যশোরের বাসিন্দা অরুণ মিত্র কলকাতার জঙ্গলে এভাবে খুঁজতেন তাঁর মাতৃভূমিকে। আর অপেক্ষা করতেন,
“আমরা জানলা দিয়ে দেখিনি
গান ঝাঁপিয়ে পড়ল কিনা রাতের গভীরে
কিম্বা কোন দরজায় গিয়ে ডাক দিল।”
অরুণ মিত্রের যশোরের সময়কাল মাত্র পাঁচ-ছয় বছর। শৈশবেই কলকাতায় এসে পড়া সত্ত্বেও ঘরের প্রতি টান কমেনি, বরং তা যেন দীর্ঘদিন তাড়িয়ে বেরিয়েছে তাঁকে। কলেজে পড়ার সময়ই আগ্রহ জন্মায় ফরাসি সাহিত্যের প্রতি। প্রবন্ধ লেখেন কলেজের ম্যাগাজিনে। ১৯৩১ সালে চাকরি নেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের সান্নিধ্যে ঠিক চাকরি নয়, মনে হত যেন নতুন কিছু করার তাগিদ চেপে বসেছে সর্বক্ষণ। ভারতের রাজনীতিতেও তখন ধারাবাহিক পরিবর্তন আসছে। বাংলা সাহিত্য ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে বামপন্থী মতাদর্শ দ্বারা। অরুণ মিত্রও জড়িয়ে পড়েছিলেন এই আন্দোলনে। ১৯৪২-এ আনন্দবাজারের চাকরি ছেড়ে যুক্ত হন ‘অরণী’ পত্রিকায়। পরের বছরের প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রান্তরেখা’। এর মধ্যে বিবাহ হয়েছে শান্তি ভাদুড়ির সঙ্গে। সাংসারিক দায়িত্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত। আবার স্বাধীনতার পরপরই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ বাড়তে থাকে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী মহলে। অরুণ মিত্র পুরোপুরি মনোনিবেশ করলেন ফরাসি সাহিত্যচর্চায়।
আরও পড়ুন
মোরগ নিয়ে কবিতা লিখলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সেই সূত্রেই জন্ম ‘পরিচয়’ পত্রিকার
১৯৪৮-এ ফ্রান্সে যান পড়াশোনা করতে। তিনবছর পর লাভ করেন ডক্টরেট উপাধি। এই সময়ে বাংলার সাহিত্যিক মহল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন তিনি। দেশে ফেরার সুযোগও হয়নি সেভাবে। সেটাই হয়তো আরো বেশি করে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল দেশকে, দেশের মানুষদের। বিদেশের মাটিতে আত্মস্থ করেছিলেন মাতৃভূমির প্রতি নাড়ির টান, “পৃথিবী আর মানুষ আর তাদের সংস্পর্শে আমার সত্তা।” ‘উৎসের দিকে’-র কবিতাগুলি যেন তারই কাব্যরূপ। ১৯৫২-তে যুক্ত হন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে। পরবর্তী কুড়ি বছর এখানেই ছিলেন তিনি। প্রকাশিত হয় ‘ঘনিষ্ঠ তাপ’, ‘মঞ্চের বাইরে মাটিতে’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ। ফরাসি সাহিত্যের বহু অনুবাদ ও মৌলিক কিছু গ্রন্থের প্রকাশও এই সময়ে।
আরও পড়ুন
কোলের উপর লুটিয়ে অভুক্ত নারী, তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়ে ফুটে উঠল তার রূপ
সাফল্য এসেছে, খ্যাতি এসেছে, কিন্তু মন পড়ে ছিল কলকাতায়। এই এক আশ্চর্য শিকড়ের টান তাঁর। যৌবনের কলকাতায় বারবার ফিরে যেতে চেয়েছেন যশোরে। আর এলাহাবাদে থাকাকালীন নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন কলকাতায়। বলছেন, “বরাবর অনুভব করেছি আমার সমস্ত শিকড় এই কলকাতায় এই বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা রয়েছে। এই অনুভূতির কথা আমার একাধিক কবিতায় প্রকাশও করেছি।” কিন্তু ফিরে এসে কী পেলেন? ছোটো দু-কামরার ঘর, অস্বস্তিকর পরিবেশ আর বাড়ির মালিকের ভ্রূকুটি। লক্ষণ দর্জির বন্ধুর কাছে অবশ্য এগুলি কোনো সমস্যাই হয়। কিন্তু ওই ছোটো ঘরে সংরক্ষণ করে রাখা যায়নি বহু দুষ্প্রাপ্য ফরাসি সাহিত্যপত্রিকা। তবুও যতই হোক নিজের ঘর, মজলিশ তো বসা দরকার। সবার আমন্ত্রণ সেখানে। ডাক দিলেন বন্ধুদের, “আমার এক চিলতে ঘর... আকাশের তারাদেরও বলি তোমরাও চলে এসো।”
১৯৯০-এ দুজনে মিলে চলে যান মেয়ের বাড়িতে। এখানে প্রশস্ত ঘর। বন্ধুদের আগমনে বাধা নেই আর। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। একটা সময় আফসোস ছিল, “বড্ড ছোট আমার ঘর, এখানে আমাদের প্রিয়দের আমি ধরাই কী করে?... বাকি থাকে এক নিজের শরীর। সেটাকে চেপেচুপে হাত মুচড়ে পা দুমড়ে একটু ছোটো করতে পারি, কিন্তু সে আর কতটুকু?” আর এখন কবির বয়স আশির উপরে। ১৯৯৭-এ চলে গেলেন সহধর্মিনী। “শূন্যতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি একা।” সবকিছু ছাই করে দেওয়ার বাসনা চেপে বসেছে মনের মধ্যে। যে ঘরের সন্ধানে, যে দেশের সন্ধানে এত লড়াই, ‘ভাঙনের মাটি’ কি আগলে রাখতে পারল তাকে? ‘উচ্ছন্ন সময়ের সুখ দুঃখ ঘিরে’ দাঁড়িয়ে রইলেন নিঃসঙ্গ কবি, জনম দুখিনীর ঘরের আগল খোলার অপেক্ষায়।
ঋণস্বীকার : কবির পাঠানো বক্তব্য, ধীরেন্দ্রনাথ কর, শিলীন্ধ্র
Powered by Froala Editor