ছোটোবেলায় একটা দুঃখ ছিল বাবুরামের সাপ দুটোর জন্য। আহারে বেচারা! সে ছোটেও না, হাঁটেও না। দিব্যি ছিল দুধ-ভাত খেয়ে, তাতেও শান্তি নেই। কে বা কারা যেন ডাণ্ডা নিয়ে তাড়া করে তাদের। নেহাতই পাঠ্যপুস্তকের সৌজন্যে পড়া, মুখস্থও ছিল কমবেশি। আসলে, ছন্দের দৌড়ে জিভের মধ্যে এমন একটা তাড়া লাগায়, এমনিই মনে থেকে যায় আজীবন। যেমন, ওই কাতুকুতু বুড়োটা। ওরেব্বাস! সে কি ভয়! হাসতে তো ভালোই লাগে, তা বলে কুলপি খেয়ে পেটের নাড়ি ছিঁড়বে কে? দরকার নেই সপ্তসাগর পাড়ি দিয়ে কেষ্টদাসের পিসির গল্প শোনার। ও, আরেক পিসিও তো ছিল। কিছুতেই বোঝা যেত না, কুমড়ো দিয়ে রাজার পিসি ক্রিকেট খেলে কী করে?
আজও যে পুরোপুরি বোঝা গেছে তা নয়, তবে নেড়ার মতো হরে দরে মাসে পঁচিশ বার বেলতলা গিয়ে কিছু শিক্ষা তো হয়েছে। সব ‘হযবরল’-র মতো জট পাকিয়ে ‘আবোল তাবোল’ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় গেছো দাদা-র মতো পালিয়ে পালিয়ে বেরোনো ব্যাপারটা মন্দ নয়। কিন্তু ধুর, সবই তো ‘ননসেন্স’। রে রে করে তেড়ে আসার কিচ্ছু হয়নি। হ্যাঁ, মানছি সুকুমারের কবিতার মধ্যে লুকোনো ব্যঞ্জনা, সমাজচেতনা, রাজনৈতিক ভাবনা আরো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু ‘একুশে আইন’-এর দেশে থোড়াই খেয়াল থাকে ওসব তত্ত্বকথা। ‘ভাবছি মনে, হাসছি কেন?’-এর মাঝে প্রশ্নচিহ্নটা জুড়ে গেলেই তো বেমালুম উধাও হয়ে যায় হাসিটা। বেরসিক জীবনে মত্ত মাদল বাজিয়ে স্বপনদোলায় নাচতেই ভালো লাগে মাঝে মধ্যে। তাছাড়া সুকুমার রায় (Sukumar Ray) তো নিজেই বলে গেছেন, “ইহা খেয়ালরসের বই।” তবে আর চিন্তা কীসের?
চিন্তা অন্যখানে। ওই যে আদর করে ‘শিকেয় তোলা’-র কথা বলে ফেলেন কিংবা খেলাচ্ছলে মুগুর মারার হালকা হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখেন, এসব কি নেহাৎ ফেলনা? তিনি তো বলেই খালাস, কিন্তু শিশুবয়সে মাথায় ঢোকেনি পাউরুটি আর ঝোলা গুড়ের মাহাত্ম্য। ওই ‘শিশুসাহিত্যিক’-এর চশমা দিয়ে তাঁকে দেখতে গিয়েই হয়েছে সর্বনাশটা। আবার, উল্টোটাও তো সত্যি। ‘আজগুবি’ ছড়ায় চিরকালীন সময় আর খেয়ালস্রোতের যে অসামান্য জাগলারিটা করে গেছেন তিনি, তার জাদুটা আজও পুরোপুরি ধরতে পারেনি সর্বস্তরের বাঙালি। সেটা আঁচ করতে পেরেই দিয়ে রেখে গেছিলেন সাবধানবাণী, “যাহা আজগুবি, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার।” এই নিয়েই বাঙালি সন্তুষ্ট ছিল গত একশো বছর, হয়তো থাকবেও যুগ-যুগান্তর ধরে।
‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত ছড়া বেছে, ছবি সাজিয়ে ‘ইউ অ্যান্ড সন্স’ থেকে যখন ‘আবোল তাবোল’ মুক্তি পায়, তখন সুকুমার রায় আর ইহলোকে নেই। বই প্রকাশিত হল ১৯২৩-এর ১৯ সেপ্টেম্বর, আর তিনি মারা গেলেন ১০ সেপ্টেম্বর। শুধু দেখে গেছিলেন মলাট আর প্রেস কপি। মাত্র ৩৫ বছরে ঘুমের ঘোর ঘনিয়ে এলেও ‘যথেষ্ট’ রেখে গেছেন বাঙালির জন্য। তাই ভাঙিয়েই তো তৈরি হয়েছে অসংখ্য প্রবাদ-প্রবচন। কথায় কথায় ‘রামগরুড়’, ‘গানের গুঁতো’, ‘গোঁফচুরি’ জুড়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে! প্রচলিত সাহিত্যচর্চায় ‘শিশুসাহিত্যিক’ বিশেষণটি নিয়েই তিনি ‘ফুটোস্কোপ’ দিয়ে দেখে গেছেন বাঙালির মুণ্ডুকে।
আরও পড়ুন
ফ্রাঙ্ক বাউমের বই থেকে ছবি নিয়ে ‘আবোল তাবোল’-এ ব্যবহার করলেন সুকুমার রায়
কী পেয়েছেন সেখানে? রাজনীতি, সমাজ, জীবন আর সময় নিয়ে অসংখ্য ‘আইডিয়া’। আসলে ‘ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না’ বলেও মুগুর হাতে যে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চেয়ে ভয়ানক আর কে হতে পারে? যে কেতাবে খোঁজে পাগলা ষাঁড়ের হাত থেকে বাঁচার উপায়, তার তো বড়ো মুশকিল! সব প্রশ্নের উত্তরেরই তো ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম!’ অবস্থা। বাঁচার কোনো রাস্তা নেই। একশো বছর আগেই তিনি দিয়েছেন গোলকধাঁধার সন্ধান। ভীষ্মলোচন শর্মার দিল্লি থেকে বর্মা বিস্তৃত ‘গানের গুঁতো’-র মধ্যে লুকিয়ে থাকে কোনো জাহাজের কামান দাগার গল্প। আবার, ১৯২২-এর সেপ্টেম্বরে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লেখার জন্য গ্রেপ্তার হন কাজী নজরুল। এই ঘটনাটুকু মনে রাখলেই বড্ড চেনা চেনা ঠেকে ‘একুশে আইন’-এর “যে সব লোকে পদ্য লেখে/ তাদের ধরে খাঁচায় রাখে।” নাকি বলছেন নকশাল আমলের কথা, বা আজকের ভারভারা রাও-এর কথা? সমকালের কথা বলব বলব করেও, বলা হয়ে যায় চিরকালের কথা। ‘একুশে আইন’-এই রয়েছে তার প্রচুর উদাহরণ। শুধু পংক্তি তুলে দেওয়াই যথেষ্ট,
"চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়ে
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়
একুশ হাতা জল গেলায়।”
আরও পড়ুন
মৃত্যুর নয় দিন পর বেরোল সুকুমারের প্রথম বই
মুক্তচিন্তা বন্ধ, রাজার সিসিটিভি ঘুরছে চারদিকে। এই পল্টনেরাই রবীন্দ্রনাথের হাতে বড়ো সর্দার হয়ে দেশ শাসন করে। বা রাতবিরেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনো জনজাতি সম্প্রদায়ের ঘরে। দেশবাসী তখন কী করে? কেন, নিশ্চিন্ত মনে দৌঁড়োয় ‘খুড়োর কল’-এর পিছনে।
সব মিলিয়ে ‘হাঁসজারু’, ‘বকচ্ছপ’-এর কিম্ভূতকিমাকার বাস্তব দুনিয়া দেখিয়ে কিছুতেই ছোটোবেলায় থাকতে দেন না সুকুমার রায়। কাকেশ্বরের হিসেবের মতো জীবন মেলে না কোনোভাবেই। প্যাঁচাদের চেঁচানির মিষ্টি আদুরে প্রেমকাহিনির পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে ‘সৎপাত্র’ গঙ্গারাম। একটু আফসোস হয় তার জন্য। এ তো নিছকই আর পাঁচটা মানুষের গল্প। তত্ত্বকথা খুঁজতে যাওয়া বাতুলতাই হবে এখানে। এবার, যে যেটা বেছে নেয় আর কি! কেউ ‘ননসেন্স’ কবিতায় খোঁজে সময়ের চিহ্ন। কারোর কাছে মন ভালো রাখার টোটকা তিনি। নিশ্চিত যে, বোম্বাগড়ের পিসির মতোই চালিয়ে খেলে যাবে আরো বহু বছর।
Powered by Froala Editor