প্রতিবারের মতো, এবারেও, সাহিত্যে কে নোবেল পুরস্কার পাবেন তা নিয়ে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা এবং উত্তেজনার কোনো ঘাটতি ছিল না। বস্তুত, নোবেলের অন্যান্য শাখার তুলনায়, সাহিত্য নিয়ে উৎসাহ বরাবরই কিছুটা বেশি থাকে, এবং তার একটা প্রধান কারণ, পদার্থবিদ্যা কিংবা রসায়নের তুলনায়, সাহিত্যে আগ্রহ দেখান এমন মানুষ, পৃথিবীর সর্বত্রই, সংখ্যায় বেশি। ফলত, প্রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র এবং সাহিত্যপত্রিকার ফিচারে, গত কয়েকদিন ধরেই, সম্ভাব্য প্রাপকের নাম নিয়ে রীতিমতো জল্পনাকল্পনা চলেছে। শুধু কি তাই, বিখ্যাত জুয়াড়ি সংস্থা ল্যাডব্রোকসের ওয়েবসাইটে, সম্ভাব্য নোবেল লরিয়েটের ওপর বাজি ধরতেও লোকজন কসুর করেনি। সেইসব তালিকায়, হারুকি মুরাকামি, মারগারেট অ্যাটউড, সলমন রুশদি বা এনগুগি ওয়া থিয়ং’ও-র মতো সর্বজনপরিচিত নাম যেমন ছিল, তেমনি, নরওয়ের জন ফসে, ফ্রান্সের অ্যানি আর্নো, রুমানিয়ার মির্চা কার্তারেস্কু, রাশিয়ার ল্যুদমিলা উলিতস্কায়া বা মোজাম্বিকের মিয়া কোউতো-র মতো অপেক্ষাকৃত অল্পপরিচিত নামও জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি, সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে, নোবেল কমিটি ২০২১-এর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন জন্মসূত্রে তানজানিয়ান লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহ্-কে (১৯৪৮—)।
বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে মোটামুটি পরিচয় থাকলেও, আমি ইতোপূর্বে এই লেখকের নাম শুনিনি। ফলত, এঁর লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্যও আমার ঘটেনি। গুরনাহ্-র নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি, সন্দেহ নেই, আমার মতো আরো অনেক পাঠকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটাতে সক্ষম হবে। আপাতত, ইন্টারনেট ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ঘেঁটে তাঁর সম্বন্ধে যেটুকু জানলাম, তার পরিপ্রেক্ষিতে, গুরনাহ-র নোবেলপ্রাপ্তির কারণ ও তা কোন প্রবণতার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে, সেইটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি।
গুরনাহ্-র জন্ম তানজানিয়ার জাঞ্জিবারে, ১৯৪৮ সালে। যখন তাঁর কুড়ি বছর বয়স, তানজানিয়ায় আরব বংশোদ্ভূত নাগরিকদের ওপর তখনই শুরু হয় অকথ্য নিগ্রহ ও নিপীড়ন। সেই অত্যাচার থেকে বাঁচতে, গুরনাহ্ দেশ ছাড়েন এবং ব্রিটেনে আশ্রয় নেন। তাঁর পড়াশুনা প্রথমে ক্যান্টারবেরি-র ক্রাইস্টচার্চ কলেজে, এবং পরে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ কেন্ট থেকে পি এইচ ডি করেন। মাঝখানে তিনবছর (১৯৮০-৮৩) নাইজেরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেও, মূলত তিনি ব্রিটেনের বাসিন্দা, এবং ইউনিভার্সিটি অফ কেন্টেই শিক্ষকতা করেছেন, অবসর নেওয়া অবধি।
গুরনাহ্-কে নোবেলসম্মানে ভূষিত করার সময়ে, নোবেল কমিটি জানিয়েছেন, ‘উপনিবেশবাদের প্রভাব, এবং সাংস্কৃতিক ও মহাদেশিক বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বাস্তুদের বিড়ম্বিত ভাগ্যের বিষয়ে তাঁর আপোষহীন এবং মরমী অনুধাবন’-ই এই পুরস্কারপ্রদানের মূল হেতু। গুরনাহ্ নিজে একজন অভিবাসী, এবং প্রথম উপন্যাস ‘নিষ্ক্রমণের স্মৃতি’ (Memories of Departure, ১৯৮৭) থেকে শুরু করে, তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাসেই উপনিবেশবাদ ও অভিবাসনের সমস্যার কথা ঘুরেফিরে এসেছে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘স্বর্গোদ্যান’ (Paradise, ১৯৯৪), যা বুকার পুরস্কারের শীর্ষতালিকায় ছিল, এবং যার কথা নোবেল-কমিটি আলাদা করে উল্লেখ করেছেন, মূলত আবর্তিত হয়েছে তানজানিয়ার এক মুসলিম বালককে ঘিরে, বিংশ শতকের গোড়ায় যে নিজেকে আবিষ্কার করছে এক জটিল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দোলাচলের মাঝখানে। তানজানিয়ার আদিবাসী-সংস্কৃতি, তার মিথ, ইসলামিক বিশ্বাসের সঙ্গে তার সংঘর্ষ, এবং সর্বোপরি, জার্মান ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে ঢুকে পড়া ইয়োরোপীয় আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক অভিযোজনের প্রক্রিয়া কীভাবে একটা ভূখণ্ড ও তার অধিবাসীদের আত্মপরিচয় নির্মাণ করছে, এই বই তার দলিল। একজন ক্রীতদাস-হিসেবে, গল্পের নায়ক ইউসুফ যখন আরব বণিকদের ক্যারাভানের সঙ্গে মধ্য আফ্রিকা ও কঙ্গো অববাহিকার মধ্যে দিয়ে যাত্রা করে, এবং স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তখন, একজন সমালোচক লিখছেন, কনরাডের ‘অন্ধকারের অন্তঃস্থল’-এর সঙ্গে তার মিলটা আর নিছক আপতিক থাকে না। বরং, কনরাডের উপন্যাসকে গুরনাহ্ তাঁর আফ্রিকান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিনির্মিত করতে থাকেন।
যদিও, এখানে মনে রাখা দরকার, গুরনাহ্-র এই উপন্যাস কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়নি। এবং, ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকায় এই বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে, অনীতা মেসন লেখেন, ‘জায়গায় জায়গায় কিছু অনুচ্ছেদ বেশ অপটু ঠেকে, যেন লেখকের কান তাঁর সঙ্গে সহসা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, আর বইয়ের বাকি অংশের সুচারু নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিচ্যুতিগুলি বেশ অপ্রত্যাশিতই।’ ফলে, নোবেল পুরস্কারের জন্য গুরনাহ্-র নির্বাচনের সাহিত্যমূল্য নিয়ে খানিকটা বিতর্কের অবকাশ যে রয়েছে, সে-কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার ওপর, নোবেল পুরস্কার আর ম্যান-বুকারের মধ্যে যে একটা মিথোজীবিতার সম্পর্ক-ও বেশ দানা বেঁধে উঠেছে ইদানীং, সেটাও নিশ্চয়ই অনেকের নজরে পড়েছে—ওলগা তোকারজুকের আন্তর্জাতিক ম্যান-বুকার পুরস্কারপ্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নির্বাচন, বারবার নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্যতালিকায় নাম-থাকা সত্ত্বেও অদ্যাবধি বঞ্চিত মারগারেট অ্যাটউডের ২০১৯-এ বুকারপ্রাপ্তি, বুকারবিজেতা কাজুও ইশিগুরোর নোবেল-লাভ সাম্প্রতিক অতীতের ঘটনা। বুকারের শীর্ষতালিকায় জায়গা করে নেওয়া গুরনাহ্-র নির্বাচন, সেই ধারায় একটি নতুন সংযোজন। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, নোবেল পুরস্কারের জন্য গুরনাহ্-কে মনোনীত করার পিছনে নোবেল-কমিটির একটি রাজনৈতিক অভিপ্রায় ছিল।
এইমুহূর্তে, ইউরোপের সামনে অন্যতম প্রধান সমস্যা উদ্বাস্তু ও অভিবাসন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ডামাডোল এবং ইসলামিক মৌলবাদের ভয়াবহতার কারণে, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ ইয়োরোপে আশ্রয় নিয়েছেন। গৃহযুদ্ধের কারণে, লিবিয়া থেকেও প্রচুরসংখ্যায় মানুষ সমুদ্রপথে ইতালিতে গিয়ে উঠেছেন। শুধুমাত্র ২০১৫ সালে, মোট ১৩ লক্ষ উদ্বাস্তু ইয়োরোপে আসেন আশ্রয়ের প্রার্থনায়। আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক পালাবদলের ফলে আবার নতুন করে উদ্বাস্তুদের ঢল নামবে, ইয়োরোপের রাজনৈতিকমহলে অনেকেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই উদ্বাস্তুসমস্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বর্ণবিদ্বেষ, নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী শক্তিও। ফলত, এহেন সংকটকালে দাঁড়িয়ে, নোবেল পুরস্কারের জন্য একজন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান লেখকের নির্বাচন, যাঁর লেখার অন্যতম বিষয় উদ্বাস্তুদের জীবনযন্ত্রণা, নোবেল-কমিটির তরফে একটি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক বিবৃতি বলেই মনে হয়েছে আমার। আবার অন্যদিকে, রাজনৈতিকভাবে দক্ষিণপন্থী এবং গণহত্যার অভিযোগে বিচারাধীন সার্বিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের সমর্থনে সরব পিটার হান্টকের নোবেলপ্রাপ্তির ফলে যে-বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, গুরনাহ্-র নির্বাচনে তা-ও অনেকটাই প্রশমিত হবে।
সন্দেহ নেই, নিজের প্রিয় লেখক নোবেল পুরস্কার না-পাওয়ায় আমরা অনেকেই কিছুটা বিমর্ষ, যেমনটা প্রায় প্রতিবারই হয়। নতুন একজন লেখকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, কেউ কেউ হয়তো আহ্লাদিতও। আমি নিশ্চিত, পরেরবার ফের, আমরা ঠিক একইরকম রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়েই অপেক্ষা করব বিজেতার নাম শোনার জন্য, তিনি যতোই অপরিচিত বা অপ্রত্যাশিত হোন না কেন। এটা একটা খেলা, এবং আমার মনে হয়, নোবেল-কমিটিও রীতিমতো মজা পান আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখে।
Powered by Froala Editor