ব্রাউন পেপারের উপর রোগা প্লাস্টিকের আলোকভেদ্য আবরণী। যাকে নতুন বইয়ের নতুন জামা বলতাম আমরা। স্মৃতির মেশিনে চাপলে দেখতে পাই অনেক কিছুই। কেউ তার বইয়ে এমন মলাট দিয়ে আনলে তাকে এক্কেবারে বেলুনের মতো ফুলিয়ে দেওয়া হত। তখন সে নয়নের মণি। স্কুলবেলার বন্ধুরা তাকে নিয়ে এমন চাটুবাক্য ব্যবহার করত যে, সে আমাদের আনন্দে টিফিন খাওয়াত। ওইটুকখানি টিফিনবক্সের নামমাত্র খাবার কোনও অদ্ভুত জাদুবলে ফুরোতো না সহজে। বাড়ি এসে মা-বাবার কাছে বায়না করতাম, অমন আলোকভেদ্য আবরণী আমার বইয়েরও মলাট হতে হবে। ছোটবেলার স্মৃতি এমনই। তা খণ্ডিতের মধ্যে সমগ্র, সমগ্রের মধ্যে খণ্ডিত। টুকরো এমন বহু স্মৃতি নরম গন্ধে ভরপুর। সপ্তাহান্তের খবরের কাগজের অতিরিক্ত পাতা বেশ রংচংয়ে হত। সেখানে নিয়মিত ছাপা হত কখনও টিনটিন, কখনও নন্টেফন্টে কিংবা হাঁদাভোঁদা। ছুটির পাতাবাহারে শোভা পেত লোভনীয় কমিক্স কিংবা গল্প-ছড়া। সেসব আগে পড়ে জমিয়ে রাখতাম সযত্নে। নতুন ক্লাসে ওঠার পর নয়া বই-খাতা এলে রঙিন ওইসব কাগজ দিয়ে বইকে পরানো হত জামা। একই প্রণালী ব্যবহার করা হত রঙিন ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রেও। বছর পুরনো ক্যালেন্ডার দিয়ে বইয়ে মলাট দিলেও তা চকচক করত। এক্ষেত্রে একটা সাধারণ নিয়ম প্রায় সব ক্ষেত্রেই চালু ছিল। ক্যালেন্ডারের ছবির সিংহভাগকে সামনে রেখে অসাধারণ কৌশলে মলাট দিয়ে দিত মা-বাবা। পছন্দের ছবি হলে বই খুলে পড়ব কী, বারবার তাকিয়ে দেখতাম মলাটের দিকেই।
আমি পড়তাম সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে। বার্ষিক অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে আসার পর এটুকু আত্মবিশ্বাস ছিল, পরের ক্লাসে উঠে যাব হেসেখেলেই। তাই পরীক্ষার পর খুব বিশেষ ছুটকারা মিলত না। বাবা প্রাথমিক শিক্ষক হওয়ায় এবিটিএ-র কিছু বইপত্তর নিয়েই আসত। মা জোগাড় করত পরের ক্লাসের বই। ব্যস, এরপর কাঁচি ও সেলোটেপ নিয়ে বসে যাওয়া। তবে, এক্ষেত্রে বই কেনার ব্যাপারে মজাদার ঘটনা ঘটত ফি বছর। মায়ের সঙ্গে ‘অ্যাপো’ ছিল এক ক্লাস উঁচুতে পড়া ‘দাদা’র পরিবারের। তাদের থেকে তার বইগুলো চেয়ে নিত রেজাল্ট বেরোনোর অনেক আগেই। এই বিষয়টিতে আমার ছিল ঘোরতর আপত্তি। ওই একই বই তো আমিও পাব। ক্লাসের সব ছেলেই পায়। ঘরে তো একই বইয়ের পাহাড় ‘অহেতুক’ জমা হবে। মায়ের যুক্তি ছিল, ‘দাদা’র বইয়ে কিছু জায়গায় দাগানো থাকে। যেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বইয়ে আগে থেকে তা পাওয়া যাবে না। তাই ডাবল ডাবল মলাট দেওয়া হত বইয়ে। পুরনো বইয়ে দেওয়া হত খবরের কাগজ দিয়ে মলাট। আর পাশ করার পর নতুন বই পরত ব্রাউন পেপারের জামা। যদিও পেন দিয়ে দাগানো ‘অপরিচ্ছন্ন’ ওই বই আমি পড়তাম না। মা-বাবা দাগানো অংশগুলি টুকে রাখত। সময়মতো সেসব আমাকে বলে দেওয়া হত। এতে ফলও মিলত হাতেনাতে।
১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকে, বেশিরভাগ ছেলেরা মার্কিন সেনাবাহিনীর উদ্বৃত্ত ন্যাপস্যাকে তাদের বই বহন করত। দরকারি জিনিসপত্র পিঠে বয়ে নেবার থলিবিশেষ হল এই ন্যাপসাক। আমি একটি পেন কেস ও ধাতব টিফিনবক্স-সহ দিনে প্রায় নয়-দশটি বই নিয়ে স্কুলে যেতাম। যা ওই ন্যাপস্যাকের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। যেন পিঠে প্রতিদিনের ওজন নিয়ে এক মেধাবী ছেলেকে চিহ্নিত করার প্রতিযোগিতা চলছে। যার পিঠের ব্যাগটা বড্ড ভারী, সে-ই যেন মেধাধারী! আর হ্যাঁ, যার বইয়ের মলাট যত বেশি সুন্দর হত, সে দেখাত তত বেশি শিভ্যালরি। যেন নিজের জীবন ‘বিপন্ন’ করে পিঠে ভারী বোঝা বয়ে এনেছে বইয়ের মলাট দেখাবে বলে। নিজেকে অতটাও প্রদর্শনীর পাত্র করে ফেলতে না পারলেও একটা কথা নিশ্চিত, মলাটই ললাট কথাটার উৎপত্তি হয়তো সেই কারণেই।
যদিও একটা সময় আমি আমার বাবা-মায়ের কোনও উপকার করিনি। তাদের কষ্ট করে দেওয়া মলাটে মনের মাধুরী মিশিয়েছি। কখনও ব্রাউন পেপার, কখনও সাদা কাগজ দিয়ে বইয়ের মলাট পরিপাটি করে দেওয়া হলেও আমি সেগুলিতে মার্জিন কার্টুন আঁকতে পছন্দ করতাম। হি-ম্যান, স্পাইডারম্যান, হাঁদা-ভোঁদার শিরস্ত্রাণ, বাহাদুর বেড়াল, বাঁটুল আরও কত কী। অমন সুন্দর ব্রাউন পেপার দিয়ে মোড়ানো মলাটকে আমার মাঝেমধ্যেই গড়ের মাঠ মনে হত। আসলে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা পাওয়া যেত। একবার তো হাঁদা, ভোঁদা আর পেট মোটা পিসেমশাইয়ের সেই বিখ্যাত কমিক্স ছবি এঁকে ফেলেছিলাম। সংলাপের অংশে লিখেছিলাম, ‘ঠিক আছে, আমার পার্টির কোন দরকার নেই; ওসব মিনমিনে পিনপিনে নয়, আমি চাই শক্তিশালীদের!’ আমার ড্রইং বেশ প্রশংসা পেয়েছিল স্কুলে। কিন্তু এই ‘উৎপাত’ বন্ধ করতে মা-বাবা দারুণ এক ফন্দিও করে। ওই সময় বাজারে আসে ব্রাউন পেপারের ওপর পাতলা প্লাস্টিকের আলোকভেদ্য সেই আবরণী। বইয়ে সেই মলাট পরিয়ে দিলে প্লাস্টিকের হরহরানির মধ্যে আর আঁকা যেত না।
আরও পড়ুন
ইউরোপজুড়ে ছাপা হত ‘বিষাক্ত বই’, দীর্ঘদিনের ব্যবহারে হতে পারে মৃত্যুও
বাবার কাছে শুনেছি, তারা ছোটবেলায় বইয়ে মলাট দিত সিমেন্টের বস্তার কাগজ দিয়ে। সেই সময় ব্রাউন পেপার দিয়ে মলাট দেওয়ার চল ছিল না। আমার ছোটবেলায় ফিরি। তখন আমার ষষ্ঠ শ্রেণি। পিছনের বেঞ্চে বসা একজন ওর বাংলা খাতায় মাধুরী দীক্ষিতের ছবি দেওয়া মলাট লাগিয়ে এনেছিল। এখানেই শেষ নয়। সেই মলাটের ছবির নিচে লাল কালির পেন দিয়ে আঁকা ছিল পান চিহ্ন। বুঝতেই পারছেন। ওই ছোকরার হার্টথ্রবের ছবি নিয়ে বেশ কাড়াকাড়ি পড়লেও অপবাদও জোটে। প্রথমে ক্লাস টিচারের বকুনি, তারপর হেড স্যারের কানে কথাটি পৌঁছে যাওয়া। ‘তুমি পাকিয়ে দিচ্ছ ক্লাসের অন্যদেরও।’ গার্ডিয়ান কল হয়েছিল তার। এরপর আমরাও বেশ কয়েকদিন ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম। ভারত যেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে হিরো কাপ জিতল, তার কয়েক মাস পর আমাদের অ্যানুয়াল পরীক্ষা ছিল। দীপাবলির এক সপ্তাহ পর ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সেই ছবি প্রত্যেক খবরের কাগজেই ছেপেছিল। তা সযত্নে রেখে দিই। পরিকল্পনা ছিল, নতুন ক্লাসে উঠলে নতুন বই বা খাতার মলাট দেব ওই ছবিটা দিয়েই। এর মধ্যেও দারুণ এক গল্প আছে। শিক্ষকরা হোমওয়ার্কের খাতা একদিনের জন্য জমা রাখতেন টিচার্স রুমে। সেখানেই খাতা দেখতেন। ক্লাসের বহু ছেলেই তাদের খাতার মলাট দিত আপন শৈলীতে। ক্লাসের সকল ছাত্রের চেক করা খাতার স্তূপ নিয়ে পরের দিন হাজির হতেন শিক্ষকমশাই। সেগুলি বিতরণ করার দায়িত্ব থাকত ক্লাসের মনিটরের। যদিও টেবিলে লম্বা করে রাখা খাতার স্তূপের মধ্যে থেকে আগেই বুঝে যেতাম, ওটা আমার খাতা। ক্লাসের বাকিরাও একইভাবে বুঝতে পারত যে, তাদের খাতা এবার আসতে চলেছে।
আরও পড়ুন
নিলামে উঠছে বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বই, বয়স হাজার বছর
মলাটের মানিকজোড় কিন্তু স্টিকার কিংবা নাম লেখার লেভেল। ক্রিকেটার কিংবা বিশ্বকাপ ফুটবলারের সব স্টিকার তো ছিলই, একইসঙ্গে টম অ্যান্ড জেরি, টিনটিন, মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক, স্পাইডারম্যানেদেরও স্টিকার ছিল। স্টিকার হিসেবে ছিল না, বাংলা কোনও কমিক্স চরিত্র। আপশোস হয়। বাংলা কমিক্স চরিত্ররা গ্লোবাল হয়ে না হয়ে ওঠার পিছনে এক প্রচ্ছন্ন গাফিলতি চোখে পড়ে। অনেকে আবার প্রিন্টেড লেভেল না লাগিয়ে পাতি সাদা কাগজ মলাটের উপর আঠা দিয়ে সাঁটিয়ে আনত। সে যাই হোক না কেন, নাম লেখার লেভেল হোক কিংবা সাদা কাগজ, সেখানে নাম, রোল নম্বর, ক্লাস বা বিষয় লিখত সে-ই যার হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। সুতরাং হাতের লেখা সুন্দর যার, তার চাহিদা তুঙ্গে থাকত ক্লাসে। কেউ কেউ আবার মলাটের উপর নানান নকশা এঁকে রাখত। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ থাকত কর্মশিক্ষার খাতার মলাটকে ঘিরে। এর জন্য আলাদা নম্বরও বরাদ্দ ছিল। যার খাতার মলাট যত বেশি সুন্দর, সে পাবে তত বেশি নম্বর। যদিও মায়ের কাছে শুনেছি, তারা বইয়ের ব্যাগ নিত না। এমনকী একটা টোটে ব্যাগও নিত না। তাদের সমসময়ে বেশিরভাগই হাতে করে বই নিয়ে স্কুলে যেত। কেউ কেউ সাইকেলে তারের ঝুড়িতে বহন করত বই। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত কোনও ব্যাকপ্যাক বা মেসেঞ্জার ব্যাগও নাকি ছিল না। তাই রকমারি রঙিন কাগজে মলাট দেওয়া বই ব্যাগের অন্দরমহল থেকে শ্রেণিকক্ষে বার হওয়ার আগেই রাস্তাতেই নজরে পড়ে যেত অনেকের। এখন সময় বদলেছে। বেসরকারি স্কুলে একচিলতে জায়গা পেতে অভিভাবককে লাখ টাকা খরচ করতে হয়। তাই সে-সমস্ত স্কুলে বইয়ের অঙ্গসজ্জায় একটা ‘কর্পোরেট লুক’ এসেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষই এখন মলাটের উপর ছাপাচ্ছে স্কুলের নাম কিংবা লোগো। হরেকরকম মলাট দেওয়ার সুযোগই পায় না আজকের প্রজন্ম।
Powered by Froala Editor