১৮৬৩ সাল। লন্ডন ছেড়ে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (Micheal Madhusudan Dutt)। অর্থাভাব তখনও নিত্যসঙ্গী। স্ত্রী হেনরিয়েটা ও সন্তানদের নিয়ে বিপদে পড়েছেন বারবার। জীবনযাত্রার খরচ কম বলে বছরের মাঝামাঝি সময়ে চলে এলেন ভার্সাই শহরে। ততদিনে বাংলায় যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মধু কবি। প্রকাশিত হয়েছে ‘মেঘনাদবধকাব্য’-সহ একাধিক নাটক ও প্রহসন। অথচ বিদেশের মাটিতে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন কপর্দকশূন্য অবস্থায়। বাড়িভাড়া বাকি, দেনার দায়ে উপক্রম হয়েছিল জেলে যাওয়ার। আর সেই সময়েই লিখেছিলেন ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’।
১৮৬৪ সালে সেখান থেকে প্রথমবার চিঠি লিখলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। বলছেন নিজের দুর্দশার কথা, এক অপরিচিত বিদেশিনীর সাহায্যের কথা। তাতে অবশ্য সমস্যা মিটছে না। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ভাবছেন আত্মহত্যার কথাও। কিংবা কোনোরকমে দেশে ফিরে খুন করবেন কয়েকজনকে। তারপর নিজেই চড়বেন ফাঁসিকাঠে। অন্তত মুক্তি পাওয়া যাবে এই অর্থাভাব থেকে। কে বলবে তিনি বাংলার বিখ্যাত ধনী ব্যক্তি রাজনারায়ণ দত্তের বংশধর? যিনি কোনোদিন টাকাকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী বলে মনে করেননি। যিনি কখনও হাত পাতেননি কারো কাছে।
আবার যেই অর্থের অভাব সামান্য দূর হল, সঙ্গে সঙ্গে জীবন থেকে মুছে গেল কষ্টের গ্লানি। তখন প্রবল উৎসাহ তাঁর। বন্ধু গৌরদাস বসাককে জানাচ্ছেন, এখানে তিনি কুঁড়েমি করে দিন কাটাচ্ছেন না। শিখে ফেলেছেন ফরাসি, ইতালীয় আর জার্মান ভাষা। স্প্যানিশ, পর্তুগিজ শিখতেও বেশি দিন লাগবে না। যেন ব্যারিস্টারি পড়তে যাননি, গেছেন নতুন দেশ আর সংস্কৃতি সম্পর্কে চর্চা করতে। কিন্তু তিনি ফিরবেন। রত্নগর্ভা বাংলা ভাষাকে সাজিয়ে দেবেন নতুন আভরণে, “আমার মাতৃভাষার মাধ্যমে এইসব ভাষার রত্নরাজির সঙ্গে আমার শিক্ষিত বন্ধুদের পরিচয় সাধন করিয়ে দেবার আশা রাখি।”
কোথায় ভার্সাই, আর কোথায় বঙ্গদেশ? নোঙর-ফেলা জাহাজের মতো তাঁকে বাধ্য হয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে ফ্রান্সের বেলাভূমিতে। ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’-র একাধিক সনেটে ফুটে উঠেছে সেই বিরহের কথা। বাল্যকালের দুর্গোৎসবের ঝাপসা স্মৃতি অস্ফুট বেদনা জাগায় ‘আশ্বিন মাস’ কবিতায়। কিন্তু দেবীর আশীর্বাদ থেকে নিজেকে কখনই বঞ্চিত করেন না তিনি। ‘মনঃপদ্ম’-এ যিনি ফুটে ওঠেন, তাঁর কী প্রয়োজন ‘মাটির দেহে’? জগতে চিরস্থায়ী তাঁর পূজা। ‘শ্রীপঞ্চমী’-তে বেজে ওঠে আগমনীর বার্তা। ‘কবির হৃদয়-বনে যে ফুল ফুটবে’, তাই দিয়েই অঞ্জলি দেবেন দেবীকে। তারপরেই বোধন হয় দুর্গার। ‘আশ্বিন মাস’-এ মহিষমর্দিনী রূপে ঘরের মেয়ে ফিরে আসছেন ঘরে। আর তিনি পড়ে রয়েছেন বিদেশে। অনিশ্চিত তাঁর ভবিষ্যৎ। বিদেশের দারিদ্র্য কেড়ে নিয়ে সমস্ত শক্তি। যদি কখনও ফিরে আসেন তিনি, তাহলে কি নিজেকে বিসর্জন দেওয়ার শক্তি খুঁজে পাবেন? শত তারার নিচে দাঁড়িয়ে কবিতার একশো পদ্মের নৈবেদ্য সাজিয়ে তিনি লেখেন,
আরও পড়ুন
মা গুপ্তমণি মন্দির: ৪৫০ বছর ধরে চলে আসছে শবরদের দুর্গাপুজো
“পূর্ব্ব-কথা কেন কয়ে, স্মৃতি,
আনিছ হে, বারি-ধারা আজি এ নয়নে?—”
আরও পড়ুন
কুমোরটুলির ভিড়, দুর্গা-অসুরের রূপ আর কিছু বিবর্তনের গল্প
ঈশ্বরী পাটনির মতো তাঁকে বারবার ছলনা করেছেন বঙ্গমাতা। নিজেও পা দিয়েছেন সেই প্ররোচনায়। যদি আবার কখনও দেখা পান সেই দেবীর, ভক্তি সহকারে চেয়ে নেবেন ‘বর-রূপ ধন’। কিন্তু জীবনের মতো ফুরিয়ে যায় উৎসবের দিনগুলি। নবমী নিশির রাত ফুরোলেই চলে আসবে ‘বিজয়া-দশমী’। আর তিনি ঘরছাড়া হয়ে থাকবেন আরো একটি বছর। কাতর কণ্ঠে আর্তি জানান ‘খ্রিস্টান’ কবি,
“যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে!
গেলে তুমি দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!—”
আবার অপেক্ষা একটা বছরের। অপেক্ষা তাঁর ঘরে ফেরার। প্রত্যাবর্তন ঘটতে কেটে গিয়েছিল আরো কয়েকটি বছর। সাহিত্যচর্চার শক্তি তখন প্রায় নিঃশেষ। যেন তারই অনুরণন শোনা যায়, “দ্বিগুণ আঁধার ঘর হবে, আমি জানি” পংক্তিতে। প্রবাসের কষ্টকর জীবনে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন শেষবারের মতো। সেই কপোতাক্ষ নদ, আমগাছের তলায় বসে রামায়ণ পাঠের স্মৃতি আসত ভিড় করে। আর শারদোৎসবের আয়োজনে এক হয়ে যায় দেবী দুর্গা আর বঙ্গভাষা। তিনি তো ‘বরাভয়দায়িনী’, তাঁর আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় না কেউ। ‘দাসে রে’ ভোলেনি বাংলা, বঙ্গভাষা।
Powered by Froala Editor