নবাগত কমল মিত্রের সাফল্যে ক্ষুব্ধ সহশিল্পীরা, জুটেছিল মিথ্যে কলঙ্ক

তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের অঘোষিত ‘পিতা’। গম্ভীর কণ্ঠস্বর আর রাশভারি চেহারা নিয়ে প্রায়ই অপমান করতে দেখা যায় নায়ক বা নায়িকাকে। তিনি উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি, অর্থের তুল্যমূল্য বিচারে মাপেন পৃথিবীর ভালোমন্দ। ‘শিল্পী’, ‘চিরদিনের’, ‘সবরমতী’-সহ কত ছবিতে যে তিনি পরিবারের কর্তা হিসেবে অভিনয় করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। কে ভুলতে পারে ‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে গান গাওয়ার জন্য একমাত্র পুত্র উত্তমকুমারের সঙ্গে বচসার দৃশ্য? তাঁর নিজের জীবনেও কি প্রায় হুবহু ঘটনা ঘটেনি? বাবা দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে পড়লে সংসারের হাল ধরার জন্য নেমে পড়তে হয়েছিল কর্মক্ষেত্রে। পাশাপাশি চলত শৌখিন নাট্যদলে অভিনয়। ভাগ্যিস সেবার আসানসোলে ‘আলমগির’ নাটকের অভিনয় দেখতে এসেছিলেন এসডিও ম্যাক ইনার্নে সাহেব। জয়সিংহ চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে পরামর্শ দিয়েছিলেন সাহেব, “কেন এখানে পড়ে আছ? তুমি নিজেই জানো না তোমার মধ্যে কী জিনিস আছে?”

তিনি কমল মিত্র (Kamal Mitra)। শুধু ‘বাবা’ চরিত্রে নয়, বাংলা চলচ্চিত্রের বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে ছড়িয়ে তাঁর নাম। অন্যদিকে পেশাদার থিয়েটার আর যাত্রাতেও দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন আজীবন। ১৯১২ সালে বর্ধমানের বিখ্যাত ‘চাঁদবার মিত্র’ পরিবারে জন্ম তাঁর। একসময় চাকরি করেছেন সরকারি কালেক্টরের অফিসে। কিন্তু রক্তে ছিল অভিনয়ের তীব্র নেশা। কলকাতায় এলেই চলে যেতেন বিভিন্ন থিয়েটার দলগুলিতে। যদি কোনোভাবে সুযোগ মেলে অভিনয়ের। তিনের দশকে বাংলা থিয়েটারের আর্থিক অবস্থা আহামরি কিছু ছিল না। অনেকেই ভাগ্যপরীক্ষা করছেন নবাগত চলচ্চিত্র মাধ্যমে। এই অনিশ্চিয়তার মধ্যে তাঁকে ঢুকতে বারণ করেছিলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দেবকী বসু।

এদিকে পরিবারেও চরম অভাব। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন না ভালো উপার্জন করতে সক্ষম হবেন, ততদিন পর্যন্ত চেয়ারে বসবেন না, খাটে শোবেন না। অবশেষে প্রতিজ্ঞা ভাঙার সুযোগ এল ১৯৪৩-৪৪ সালে। গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘নীলাঙ্গুরীয়’ ছবিতে মিলে গেল ‘এক্সট্রা’ চরিত্র। কোনো পারিশ্রমিক নেই। মাত্র এক লাইন সংলাপ। টেবিল চাপড়ে বলতে হবে, “আপনি তো দেখছি মশাই একটি বর্ণচোরা আম!” আর তাঁর জীবনের প্রথম সংলাপেই বাংলা চলচ্চিত্র সন্ধান পেল এক খাঁটি ‘বর্ণচোরা আম’-এর। যিনি এতদিন ধরে ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন নাট্যদলে, সিনেমার স্টুডিওয়। অ্যামেচার নাটকে রাতের পর রাত মুগ্ধ করে রাখছেন দর্শকদের। এরপর এসে গেল দেবকী বসুর হিন্দি ছবি ‘রামানুজ’-এ অভিনয়ের সুযোগ। জীবনে প্রথম পারিশ্রমিক পেলেন তিনি। কুড়ি টাকা।

আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দেবকী বসুর বেশ কয়েকটি হিন্দি ছবির পাশাপাশি ডাক আসতে থাকে বাংলা চলচ্চিত্রেও। তবে আশচর্যের বিষয় অধিকাংশই বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। পরবর্তীকালে ‘বাবা’ হওয়ার প্রস্তুতিও বোধহয় তখন থেকেই শুরু হয়ে গেছিল। এমনকি দেবকী বসুও তাঁকে বলেছিলেন, “আপনি কখনও নায়ক করবেন না। মানাবে না। আপনি চরিত্রাভিনয় করবেন।”

আরও পড়ুন
দেবকী বসুর পরিচালনাতেই প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ ভারতীয় সিনেমার

১৯৪৪ সাল। কাজের সূত্রেই পরিচয় হল অভিনেতা বিপিন গুপ্তের সঙ্গে। তিনিই একপ্রকার জোর করে কমল মিত্রকে নিয়ে গেলেন স্টার থিয়েটারে। পরিচালক-প্রযোজক মহেন্দ্র গুপ্ত তখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন ‘টিপু সুলতান’ নাটকের। সেখানে সুযোগ মিলল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের। সঙ্গে মাসে পঞ্চাশ টাকা মাইনে। একই সঙ্গে চলছিল বিভিন্ন সিনেমার কাজ। অবশেষে সরকারি চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি পেশাদারভাবে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হলেন কমল মিত্র। পরের বছরই স্টারে ‘গৈরিক পতাকা’ নাটকে মূল চরিত্র শিবাজীর ভূমিকায় দেখা গেল তাঁকে। আশীর্বাদ পেলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীর থেকে। সিনেমা জগতেও ততদিনে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের নাম।

আরও পড়ুন
গান গাইতে হবে পরবর্তী সিনেমায়, সুমিত্রার কাছে অনুরোধ উত্তমকুমারের

যদিও তাঁর সাফল্য চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল অনেকের কাছে। বিপিন গুপ্ত চলচ্চিত্রের কাজে মুম্বই চলে যাওয়ার পর ‘টিপু সুলতান’-এর নামভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ এসে গেল কমল মিত্রের কাছে। হাতে মাত্র পাঁচদিন সময়, দলের মধ্যে এই চরিত্রের দাবিদারও অনেক। তাই মহেন্দ্র গুপ্ত অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ডেকে নিলেন তাঁকে। কেউ যেন জানতে না পারে তাঁকে বেছে নেওয়ার কথা। আলাদা করে কোনো রিহার্সালও হবে না। একেবারে সরাসরি তিনি নাট্যমঞ্চে আবির্ভূত হবেন টিপু সুলতান রূপে। 

শুনে তো রীতিমতো চমকে গেলেন কমল মিত্র। এই সামান্য সময়ে, রিহার্সাল ছাড়া এত বড়ো চরিত্র! রাতে ঘুম হল না। ভয়ের চোটে জ্বর চলে এল। কিন্তু ক্রমাগত উৎসাহ জুগিয়ে গেলেন মহেন্দ্র গুপ্ত। এমনকি অভিনয়ের দিন মঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রম্পটিংয়ের জন্য। শুরু হল মরিয়া অভিনয়। মাঝেমধ্যে দর্শকদের হাততালি ছাড়া কিছুই আর কানে ঢুকছে না। নির্বিঘ্নে শেষ হল দুটি অঙ্কের অভিনয়। হঠাৎই এক খ্যাতনামা সহ-অভিনেত্রী ক্ষোভ উগরে দিলেন তাঁর উপরে। কীভাবে হাত তুলতে হয়, সেটুকু বোধও নাকি হয়নি তাঁর। কী ব্যাপার? ভুল করে কি গায়ে হাত লেগে গেছে? হলেও সেটা ইচ্ছাকৃত নয়। আর মঞ্চে তো হতেই পারে এরকম ঘটনা। যদি ওই অভিনেত্রী অভিযোগ জানান মহেন্দ্র গুপ্তের কাছে? তাই নিজেই গেলেন পরিচালকের কাছে সমস্ত বিষয় খোলাখুলি বলতে। 

চুপ করে সমস্ত শুনলেন মহেন্দ্র গুপ্ত। তারপর জানালেন, এক নবাগত অভিনেতার উত্থান অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। আসলে বাকিরা ‘সেটিং সান’। তাদের উস্কানির সমবেত ক্ষোভ ঝরে পড়েছে অভিনেত্রীর মিথ্যে অভিযোগে। কারণ, “আপনার অভিনয় বিপিনবাবুর চেয়েও ভালো হচ্ছে। বিপিনবাবু যে ক’জায়গায় ক্ল্যাপ পেতেন, সেখানে তো আপনি পাচ্ছেনই, তাছাড়া এক্সট্রা দু’জায়গয়ায় পেয়েছেন। আপনার কোনো ভয় নেই। আপনি নিশ্চিন্তে কাজ করুন। আপনার পেছনে আমি আছি।”

পারস্পরিক হিংসা-ক্লেদের এই দুনিয়া থেকেই নিজেকে তুলে নিয়ে গেছিলেন অন্য উচ্চতায়। তাঁর স্পষ্ট কথার মুখোমুখি হতে ভয় পেতেন অনেকেই। স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছিলেন অভিনয়। জীবন বেঁচেছেন রাজার হালে। পরবর্তীকালে থিয়েটারের কর্ণধার হিসেবে হয়ে উঠেছিলেন অভিনেত্রীদের ‘লোকাল গার্জেন’। কারণ, তিনি যে বাংলা সিনেমার অঘোষিত ‘কর্তা’। 

ঋণস্বীকার : সাত রঙ- রবি বসু

Powered by Froala Editor