“আমরা ছিলাম মাটির তাল, গুরুদেব আমাদের হাতে ধরে গড়েপিটে তৈরি করে নিয়েছেন।” নিজের সম্পর্কে বলতেন ক্ষিতিমোহন সেন। তবে বিনয় মিশ্রিত অত্যুক্তি আছে এই কথায়। ‘মাটির তাল’ নয়, সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য ও শাস্ত্রের অগাধ জ্ঞানসমৃদ্ধ মানসপ্রতিমা নিয়েই তাঁর শান্তিনিকেতনে আগমন। রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার সাহচর্য ও শান্তিনিকেতনের মুক্ত জ্ঞানচর্চার পরিসর, তাঁর ক্ষেত্রকে ছড়িয়ে দিয়েছিল বিস্তৃত কর্মমার্গে। যা সমৃদ্ধ করেছিল স্বয়ং ‘গুরুদেব’কেও। মধ্যযুগের সন্তজীবনের কথাকার, বৌদ্ধ সংস্কৃতির গবেষক, দেশীয় লোকসঙ্গীতের সংগ্রাহক, সর্বোপরি নীতিবান শিক্ষক ও দক্ষ সংগঠক ক্ষিতিমোহনের আবির্ভাব শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে পরিপূর্ণতা প্রদানে সহায়ক হয়ে উঠেছিল। সাধে কি আর কবি বলতেন, “তাঁকে আমি হাতছাড়া করতে চাইনে”?
অথচ দুই ব্যক্তির জীবনচর্যা চলছিল সমান্তরাল রেখায়। কীভাবে যেন কোন দৈবমুহূর্তে ‘মিলন হল দোঁহে’। জহর চিনতে ভুল করেননি রবীন্দ্রনাথ। তাই তো ‘তাঁকে বোলপুরে আবদ্ধ করতে এত উৎসুক’ হয়েছিলেন তিনি। সম্ভবত কালীমোহন ঘোষের মুখেই প্রথম শুনেছিলেন ক্ষিতিমোহনের কথা। এক শাস্ত্রজ্ঞ যুবক পল্লী উন্নয়নের কাজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সাহিত্যপ্রীতির পাশাপাশি অবদান রাখছেন লোকসেবাতে। এরকম মানুষই তো খুঁজছেন রবীন্দ্রনাথ। সেটা ১৯০৭-০৮ সাল। শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বভার সামলানোর জন্য উপযুক্ত লোক দরকার। যিনি কোনো সংকীর্ণতায় আবদ্ধ থাকবেন না। যিনি সমস্ত ভেদনীতির ঊর্ধ্বে। একই সঙ্গে ভারতীয় ধর্ম-দর্শনের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটাবেন বৈশ্বিক আত্মীয়তার। ক্ষিতিমোহনের মধ্যে তার সকল বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি।
ক্ষিতিমোহন অবশ্য পূর্বেই পরিচিতি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের। আর পাঁচজন বাঙালির মতো কবিতাপাঠের সূত্রে সেই আলাপ। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে কাশীতে। বলতেন, “কাশী আমার জন্মভূমি, শিক্ষাভূমি, গুরুস্থান। এই স্থানে আমি চিরবালক।” দশাশ্বমেধ ঘাটে সাধু-সন্ন্যাসীদের বাণী শুনতে শুনতেই যৌবনের প্রাকলগ্নে মর্মে প্রবেশ করল ‘কড়ি ও কোমল’-এর সুর। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনা। কিন্তু তাঁর মনে হল, “আমি সেই কাব্যের মধ্যে চিরপরিচিত উপনিষদ ও সন্ত-কবিদের ভাব দেখতে পেলাম। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমার পরম আত্মীয়।” এরপর কাশীতেই স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৯০২ সালে এম.এ পাশ করেছেন। বছর পাঁচেক আগে থেকেই নিয়মিত কাজ করে চলেছেন বাউল সংগীত ও তার অর্ন্তনিহিত তত্ত্ব বিষয়ে। পরে রবীন্দ্রনাথকেও তিনি শুনিয়েছিলেন শেখ মদন, বাউল গঙ্গারামের গান।
১৯০৪ সালে কাশী থেকে কলকাতায় এলেন এক সুপ্ত আশা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধপাঠ শুনবেন। সেদিনের সভায় অগুনিত মানুষের ভিড়। নেহাত উদ্যোক্তাদের মধ্যে দুয়েকজন পরিচিত ছিল বলে ঠাঁই মিলল মঞ্চের পিছন দিকে। মুখ দেখা হল না, কিন্তু সেটাই প্রথম দেখা। এমনকি সংকোচবশে আলাপও করা হল না। তখনও জানতেন না যে, বছর কয়েকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই স্বয়ং ডেকে নেবেন তাঁকে। ১৯০৭ সাল নাগাদ তিনি কর্মসূত্রে চলে গেলেন দেশীয় রাজ্য চম্বায়। এদিকে রবীন্দ্রনাথের কানে উঠল তাঁর নাম। ক্ষিতিমোহনের জ্ঞান ও কর্মের অধ্যায়ে ব্যক্তি নয়, লুকিয়ে ছিল বহু যুগের ভারত ইতিহাসের এক দীর্ঘ বহমান স্বপ্ন। তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালির ‘বইপড়া’ বিদ্যার অহংয়ের মধ্যে যা কোনোদিন খুঁজে পাননি তিনি।
আরও পড়ুন
‘অসময়ে ভারতবর্ষে আসিবার চেষ্টা করিও না’, জগদীশচন্দ্রকে মিনতি রবীন্দ্রনাথের
চম্বায় তখন রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন ক্ষিতিমোহন। সংস্কৃত কাব্যপাঠের গুণে রাজপুরুষরা পর্যন্ত ভক্ত তাঁর। সেই সময়েই রবীন্দ্রনাথের তরফ থেকে এল শান্তিনিকেতনের কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান, “যদি অনুগ্রহ করিয়া আমার এই কার্য্যে যোগদান করেন তবে আমি সহায়বান হইব।” কদিন পরে চিঠি এল বন্ধু বিধুশেখরের কাছ থেকে। এখানেও একই আবেদন। এত বড়ো দায়িত্ব? তিনি কি আদৌ এর যোগ্য? আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হল দ্বিধা। ক্রমে নিজেকে মনে হল আশ্রমের কাজের ‘অযোগ্য’। সঙ্গে প্রবল হয়ে দাঁড়াল অর্থনৈতিক বাধা। পুরো পরিবারের দায়িত্ব তাঁর উপরে। রবীন্দ্রনাথ আর্থিক ক্ষতি না হওয়ার ব্যবস্থার কথা বললেও, তা নিশ্চয়ই চম্বার থেকে যথেষ্ট কম। নিজের সঙ্গে লড়াই চলল বেশ কয়েকদিন। এদিকে রাজাও অনুমতি দিতে নারাজ। নিজের অপারগ দোলাচলতা জানিয়ে চিঠি দিলেন রবীন্দ্রনাথকে।
আরও পড়ুন
অমর্ত্য সেনের শান্তিনিকেতনী শিক্ষা এবং ‘জগৎ কুটির’-এ বাড়ির সন্ধান
শেষ অনুরোধ জানালেন কবি। ক্ষেত্র প্রস্তুত, শুধু কর্ষণের অপেক্ষা। এবার আর তাঁকে ফেরাতে পারলেন না ক্ষিতিমোহন। যদিও বা অনুমতি মিলল, তখন শুরু হল অর্থের রফা। চম্বায় তিনি মাসে ১১০ টাকা করে পাচ্ছেন। প্রতি বছর ১০ টাকা করে বেড়ে যাওয়ার কথা। সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ যদি ১০০-১৫০ টাকার ব্যবস্থা না করেন, তাহলে তার পক্ষে আসা অসম্ভব। তিনি বিবাহিত, বাবা-মা বয়স্ক, মৃত দাদার পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে, ফলে অর্থের বিষয়টি তিনি প্রথমেই পরিষ্কার করে নিতে চান। একাধিক চিঠিতে জানালেন সে কথা। ১৯০৮ সালে সমস্ত দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “যত শীঘ্র পারেন, আমাদের জালে আসিয়া ধরা দিবেন।” ‘লেনদেনের কারবার’-এর প্রথম পর্বে জয়ী হলেন ক্ষিতিমোহন। ‘ব্যবসা মোর তোমার সাথে/ চলবে বেড়ে দিনে রাতে।’ তারপর কিন্তু শুধুই জয়ের পালা। অর্থের দিক থেকে নয়, জীবনে আর জ্ঞানে। পরে লিখেছিলেন, “শান্তিনিকেতন আশ্রমে একটানা ৩৪ বৎসর গুরুদেবের সঙ্গে কাজ করিবার এবং ঘন সান্নিধ্যে আসিবার পরম সৌভাগ্য কয়জনের ঘটিয়াছে?” পালন করেছিলেন উপাচার্য্যের দায়িত্ব। মাসে ১৫০ টাকা বেতন পেয়েছিলেন কিনা, সে প্রসঙ্গ অবান্তর। বরং রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ‘নবরত্ন’-এর এক রত্ন। দ্বিতীয় দফায় কিন্তু জিতে গেলেন তিনি...
ঋণস্বীকার : আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন সেন
আচার্যের প্রতিভাষণ, ক্ষিতিমোহন সেন
ক্ষিতিমোহনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি, দেশ, ১৯৮৬
অপ্রকাশিত আত্মস্মৃতি, ক্ষিতিমোহন সেন
ক্ষিতিমোহন সেন ও অর্ধশতাব্দীর রবীন্দ্রনাথ, প্রণতি মুখোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor