ভুলতে পারেননি বাংলার নদীদের, বিদেশেও পদ্মা-মেঘনার রূপ খুঁজতেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী

জীবনের একটা বড়ো সময় তিনি কাটিয়েছেন বিদেশে। ইংরেজ মনীষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আকর্ষণ গোপন করেননি কখনই। সাহিত্যচর্চার প্রধানতম ভাষা হিসেবেও গ্রহণ করেছিলেন ইংরেজিকে। তবু, বাংলা ভাষায় তাঁর মতো অসামান্য নৈপুণ্য দেখাতে পেরেছেন ক’জন? রাজনীতি, ইতিহাস, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রশিল্প—সর্বত্র তাঁর অবাধ যাতায়াত। আর অবশ্যই নীরদচন্দ্র চৌধুরীর (Nirad C. Chaudhuri নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অসংখ্য বিতর্ক। স্পষ্টবাদিতা আর তীক্ষ্ণ বিদ্রূপে পরিপূর্ণ তাঁর সাহিত্যকর্ম অপছন্দ হতেই পারে, কিন্তু অস্বীকার করা মুশকিল। 

নীরদচন্দ্র চৌধুরীর জন্ম ১৮৯৭ সালে, বর্তমান বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। সেখানকার স্কুলে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে চলে আসেন কলকাতায়। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক হলেও, অনুত্তীর্ণ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায়। ইতি টানেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনাতেও। কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কেরানি হিসেবে। এই সময় থেকেই ইংরেজি ও বাংলায় লেখালেখি শুরু করেন বিভিন্ন পত্রিকায়। ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন ‘শনিবারের চিঠি’-তে। 

কিন্তু ১৯২৭ সাল নাগাদ সম্পূর্ণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বাংলা লেখা নিয়ে। কেন? প্রথমত, তাঁর গদ্যের ছাঁচ ছিল খানিক ‘প্রাচীনপন্থী’। মনে হয়েছিল, ১৯১০-এর পর বাংলা ভাষা প্রাঞ্জলতা হারিয়েছে। ‘আজিকার’ বাংলা ভাষা তিনি বোঝেন না, তাই “ইহার মাধ্যমে লিখিবার সাধ্য আমার নাই, নীচু গলায় বলিব—ইচ্ছাও নাই।” যে কারণে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাঙালী জীবনে রমণী’ আদ্যোপান্ত সাধুভাষায় লেখা। দ্বিতীয়ত, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ‘আইডিয়া’ প্রচার করা, জনপ্রিয় সাহিত্যিক হওয়া নয়। অথচ, ধারাবাহিক লেখালেখি করেও পর্যাপ্ত সাড়া পাওয়া যায় না পাঠকদের থেকে। তাই ‘বাংলাদেশে লেখকবৃত্তি নিষ্ফল’। মোহিতলাল মজুমদারের আবেদন সত্ত্বেও আর ফিরে তাকাননি বাংলা ভাষায় সাহিত্যরচনার দিকে।

প্রকৃত অর্থে তিনি বাংলা লেখায় ফিরলেন ১৯৬৬ সালে। সেই বছরই প্রয়াণ ঘটে নন্দলাল বসুর। তাঁর স্মৃতিতে একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকায়। সেটাও সম্ভব হত না, যদি না সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা দিতেন। এই প্রবন্ধের সূত্র ধরেই ৭০ বছর বয়সে বাংলা লেখায় পুনঃপ্রবেশ নীরদচন্দ্রের। গত ২৩ বছর ধরে তিনি দিল্লিনিবাসী। পাকাপাকিভাবে ইংল্যান্ডে চলে যেতে আরও বছর কয়েক বাকি। তবুও নিজেকে মনে করেন, “পূর্ববঙ্গের গ্রাম্য বালকই আছি, আর কিছু হইতে পারিলাম না।” কারণ, তিনি কখনই ভুলতে পারেননি বাংলার জলরাশিকে। তাই সত্তর বছরেও এতটা সজীব, এতটা উচ্ছ্বল। উচ্চশিক্ষার জন্য যখন কিশোরগঞ্জ ছাড়েন, তখন তিনি সদ্যকিশোর। তারপর কলকাতা হোক বা দিল্লি, আর কোনোদিন দৃঢ়ভাবে শিকড় গেঁথে নিতে পারেননি, ফিরে যেতে পারেননি মাতৃভূমি কিশোরগঞ্জেও। দেশভাগ নিয়ে তাঁর সবচেয়ে বড়ো আপত্তির জায়গা ছিল এখানেই। বৈষয়িক যে ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে কলহের মধ্যে বাঙালি ভুলেই গেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারানোর বেদনা। সেই যন্ত্রণা, সেই আর্তি স্বেচ্ছায় বহন করে নিয়ে যেতে চান আজীবন।

আরও পড়ুন
ফরাসি সাহিত্যচর্চায় পেয়েছিলেন সম্মান, বাঙালির কাছে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম লোকনাথ ভট্টাচার্য

তাই হয়তো দিল্লিতে যমুনা দেখে মনে পড়ে গ্রাম বাংলার অভিজ্ঞতা। যমুনা নদী কলকাতা সংলগ্ন অঞ্চলের গঙ্গার মতো দু’দিক থেকে ঘেরা নয়। তাই হয়তো যমুনার মধ্যে এখনও ‘উদ্দামতা’, এখনও ‘গ্রাম্যতা’ বেঁচে রয়েছে। কিন্তু, যতই হোক এ নদী কালিন্দী বা মেঘনা নয়। ১০ বছর বয়সে ভৈরববাজারের কাছে মেঘনার বন্যার যে ভয়ানক রূপ দেখেছিলেন, তা কীভাবে ফিরিয়ে দেবে উত্তরাপথের নদী? ঠিক একই কথা মনে হয়েছিল এক সন্ধ্যায় ইজরায়েলের ‘সি অফ গ্যালিলি’ হ্রদের পারে গিয়ে। মাইল পনেরো লম্বা আর মাইল পাঁচেক চওড়া হ্রদের আকারের সঙ্গে হয়তো পদ্মা-মেঘনার কিছুটা মিল পাওয়া যায়। তবে সেই অবাধ উচ্ছৃঙ্খলতা কোথায়? এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, “যীশু যে ঝড়কে শান্ত করিয়াছিলেন, তাহা কি এই হ্রদে সম্ভব?” উত্তরে হ্যাঁ শুনে একটু অবাকই হয়েছিলেন তিনি। পরদিন ভোরে দেখলেন তার গর্জনশীল রূপ। ঝড় উঠেছে কোথাও একটা। তার প্রভাব বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে ‘সি অফ গ্যালিলি’-কে। কিংবা হয়তো চূর্ণ করতে চেয়েছিল এক বিদেশি পর্যটকের আত্মগত অহংকার। ঝড় থামলে “চাহিয়া দেখি, সী অফ গ্যালিলির নীল জল কালো হইয়া গিয়াছে—ঝটিকাবিক্ষুব্ধ মেঘনার কথা স্মরণ হইল।”

আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও বাঙালির তৈরি প্রথম থিয়েটারের গল্প

শুধু এখানে নয়, ইংল্যান্ডের টেমস বা আইসিস নদীতেও বারবার খুঁজেছেন কিশোরগঞ্জের নদীদের। আর হতাশ হয়েছেন বারবার। এই নদীরা দেশের দিকে মন ফেরালেও ঠিক দেশের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারে না। নীরদচন্দ্র চৌধুরী এর সঙ্গে মিশিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প, বঙ্কিমের উপন্যাস আর সত্যজিতের সিনেমাকে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের নদীপ্রান্তের গল্পগুলি ‘উদার ও করুণ’, কিন্তু কলকাতার প্রেক্ষাপটে তৈরি কাহিনি আর্টের দিক থেকে উঁচুদরের হলেও তাদের পরিণতি নিষ্ঠুর। নদী যেখানে আপন ছন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সৃষ্টিকে, সেখানে এই বিরাট প্রকৃতি হারানো নিয়ে কি উত্তাপ আছে বাঙালির মধ্যে? নীরদচন্দ্র বিদেশবাসী, বহু বিতর্কে জর্জরিত। কিন্তু যে বাঙালি ‘মানসিক বিকলতা’-য় সর্বস্ব হারিয়েছে, তাকে বাঁচাবে কে? “প্রাণ গেলে দীনতা হইতে ত্রাণ নাই।” নীরদচন্দ্র তাই হয়তো বারবার বিঁধতে থেকেছেন ‘আত্মঘাতী’ বাঙালিকে। 

Powered by Froala Editor