মা কালীর যে রূপ আমাদের পরিচিত, আশৈশব চেনা, সেই রূপ নিয়ে আমাদের কৌতূহলও কম নয়। চিরচেনা হয়েও তিনি যেন চির-রহস্যময়ী, অদ্ভুত এক দিব্যসত্তা। তাঁর এই অদ্ভুত মূর্তিকল্পের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে লেখালেখি প্রচুর। রামপ্রসাদ, বিমলানন্দ, রামকৃষ্ণ কিংবা নজরুল ইসলাম— প্রত্যেকেই নিজস্ব উপলব্ধি অনুসারে দেবীর রহস্য ব্যক্ত করেছেন। কেউ গানে, কেউ কথায়, কেউ বা দেবভাষার টীকা-টিপ্পনীতে। আজ, এই বিষয়ে মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ (Gopinath Kaviraj) কী বলেছেন, একটু আলোচনা করা যাক।
গোপীনাথ বলছেন, কালী পরাশক্তির বিবিধ সাকার প্রকাশের অন্যতম৷ দক্ষিণাকালী, বামাকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, কামকলাকালী আদি অনেক রূপ তাঁর। বঙ্গদেশে তাঁর 'দক্ষিণাকালী' রূপটিই সকলের চেনা।
দক্ষিণাকালীর পায়ের নিচে রয়েছেন শবরূপী শিব। শিবের চৈতন্যশক্তি যখন তাঁর শরীর থেকে বহির্গত হয়ে বাইরে প্রকাশিত হন, তখনই শিব হয়ে যান শব। সেই শবের উপরেই ক্রীড়ারতা হন চৈতন্যরূপিণী শক্তি। শিবের বুকেই কালীর লীলা, শিবত্ব প্রাপ্ত না করে কেউ কালীকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। আর কেবল শিব হলেই চলবে না, শিবত্বপ্রাপ্তির পর শবাবস্থায় গিয়ে, তবে কালীর উদ্দেশ পাওয়া যাবে। অমনধারা শব হতে শিবই পারেন, জীব পারে না।
মা কালী চতুর্ভুজা। তাঁর বামদিকের ঊর্ধ্বহস্তে খড়্গ, নিম্নহস্তে অসুরমুণ্ড। কোন অসুরের মুণ্ড এটি? গোপীনাথ বলছেন, তার নাম 'মহামোহ', সে মানুষের সমস্ত বিভ্রান্তির উৎস। তাই আত্মজ্ঞানরূপ খড়্গের আঘাতে মা তার মুণ্ড ছিন্ন করেছেন, তিনি যে ভক্তদের সমস্ত বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দেন! মা কালীর দক্ষিণদিকে ঊর্ধ্বহস্তে অভয়মুদ্রা, এই হাতে তিনি মুক্তিকামী ভক্তদের মোক্ষপ্রদানের আশ্বাস দিচ্ছেন। আবার নিম্নহস্তে বরমুদ্রা, এই হাতে তিনি জাগতিক সুখভোগে ইচ্ছুক ভক্তদের দিচ্ছেন স্বর্গসুখ আদি বর। অর্থাৎ, মা চতুর্বর্গফলপ্রদা।
আরও পড়ুন
বুকের ওপর মূর্তি রেখে সাধনা; কমলাকান্তের আরাধ্য কালীই বজবজের ‘খুকি’!
মানুষের শরীরে যে ষটচক্র, তাতেই পঞ্চাশটি বর্ণের অবস্থান। মূলাধারে চার, স্বাধিষ্ঠানে ছয়, মণিপুরে দশ, অনাহতে বারো, বিশুদ্ধে ষোলো, আজ্ঞাচক্রে দুই—মোট পঞ্চাশটি বর্ণমালা। এই পঞ্চাশৎ বর্ণমালাই যাবতীয় বিকল্পের মূল। এদের সবাইকে জ্ঞানখড়গে ছিন্ন করে মা কালী মুণ্ডমালারূপে করেছেন নিজের কণ্ঠভূষণ৷ যা ছিল অশুদ্ধ বিকল্প, মায়ের শাসন পেয়ে, মায়ের ভূষণ হয়ে তাই হয়ে উঠেছে শুদ্ধ বিকল্প। এই হল শুদ্ধ অহং। বলা চলে, কাঁচা আমি থেকে পাকা আমি, কিংবা ছোটো আমি থেকে বড়ো আমি হওয়া।
আরও পড়ুন
কালী, মহালক্ষ্মী, দীপাবলি, দিওয়ালি
এ হেন মা দিগম্বরী। তিনি আকাশস্বরূপিণী, তাঁকে আবরণ করবে সাধ্য কার? তাঁর লোলজিহ্বার অর্থ, তিনি স্বয়ং নির্বিকল্প অবস্থায় বিরাজিতা। গোপীনাথের এই বক্তব্যের সূত্রে মনে আসে, বৌদ্ধ দেবী নৈরাত্মার কথা। এমন এক অবস্থা, যেখানে 'অহং' বা আত্মবোধ অবধি লুপ্ত, কেবল অপার শূন্যতা৷ আবার উপনিষদ কিন্তু বলছে, দেবী 'শূন্যসাক্ষিণী'। যে অবস্থায় কেউ নেই, কিছু নেই, সেই অবস্থা যে আছে, তার সাক্ষী কে? সাক্ষী হলেন কালী, কাল বা সময়ের অতীত তিনি। তিনি শূন্যসাক্ষিণী।
গোপীনাথ বলছেন, পরাশক্তির তিন রূপ— কালী, তারা, ষোড়শী। যখন সংসারের সমস্ত ঐশ্বর্য, সমস্ত মাধুর্য শোষিত হয়েছে, তখন যে পরচৈতন্যের স্পন্দন জেগে ওঠে, তাইই হল কালী। এই হল অমাবস্যার সূচনা। আর এর বিপরীতে পূর্ণিমা, কালীর বিপরীতে ষোড়শী। কালী থেকে ষোড়শীর দিকে এই যে যাত্রা, এই যাত্রাপথেই আছেন তারা। তারা, অর্থাৎ যিনি তারিণী, যিনি উদ্ধারকর্ত্রী। আর তারপর, পূর্ণিমারূপিণী ষোড়শী। তিনি অনন্ত ঐশ্বর্যময়ী, তাই তিনি রাজরাজেশ্বরী; তিনি অনন্ত সুন্দরের নায়িকা, তাই তিনি ললিতা, তিনি ত্রিপুরসুন্দরী।
গোপীনাথ কবিরাজের দৃষ্টিতে, এই হলো পরাশক্তিকে অনুভবের ক্রম। এ ক্রমের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে তাঁর 'নবমুণ্ডী মহাসন' আদি বিবিধ রচনায়।
তথ্যসূত্র: গোপীনাথ কবিরাজ, 'শ্রীসাধনা' বইয়ের অন্তর্গত 'কালী-রহস্য' প্রবন্ধ।
Powered by Froala Editor