বীরেন্দ্র-কণ্ঠে ধূসর সংস্কৃত-বাংলার ফারাক, আপনমনে বাজিয়ে চললেন মুসলিম যন্ত্রীরা

‘মহালয়া’ আর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’—দুটি শব্দ বাঙালির কাছে এক হয়ে গেছে বহুদিন। অসুরদলনী দুর্গার আগমনবার্তা ধ্বনিত হয় ‘য়া চণ্ডী মধুকৈটভাদি’-র স্বর্গীয় সুরে। মা আসছেন, যেমন বছরের এই একটি দিন ধুলোপড়া রেডিও আবার ফিরে আসে স্বমহিমায়। অনেক অভ্যেস ছাড়ার যুগেও কিন্তু কীভাবে যেন ঘুম ভেঙে যায় সেই ভোরবেলায়। ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে’ ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না বাঙালির উৎসব। ১৯৭৬-র ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্‌’-র একটি বছর বাদ দিলে জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে মহালয়ার রেডিও। কত গল্প, কত স্মৃতিকথা জড়িয়ে সেই পথচলার ইতিহাসে।

কলকাতার বেতারের প্রভাতী অনুষ্ঠানের সূচনা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সম্প্রচারের বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। ১৯৩০ থেকে সোম ও বুধবার ভোরে হীরেন্দ্রকুমার বসুর তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছিল কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতের অনুষ্ঠান। সেই সূত্রেই শ্রীশ্রী মার্কণ্ডেয়চণ্ডীর বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে বাণীকুমার (Bani Kumar) নির্মাণ করেন ‘বসন্তেশ্বরী’ নামের একটি চম্পূ। ১৯৩২ সালের মার্চ মাসে, অর্থাৎ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের চৈত্রের শুক্লা অষ্টমীর সকালে বাসন্তী আর অন্নপূর্ণা পূজার সন্ধিক্ষণে সম্প্রচারিত হয় ‘বসন্তেশ্বরী’। তারই পদচিহ্ন অনুসরণ করে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের মহাষষ্ঠীর ভোরে দেবীর মহিষাসুর বধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন আয়োজনে বেজে উঠল এক গীতি-আলেখ্য। তখনও ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র নাম আসেনি বাঙালির ইতিহাসে।

১৯৩৬ সালের ২১ অক্টোবর ভোরে কলকাতা-ক কেন্দ্র থেকে ভোর ছটায় শুরু হল ‘এক বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান’। নব্বই মিনিটের এই অনুষ্ঠানটির নাম ‘মহিষাসুর বধ’। রচনা ও প্রযোজনা—বাণীকুমার। সুর—পঙ্কজকুমার মল্লিক (Pankaj Kumar Mullick)। পরের বছর থেকে যার নতুন নাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। আরো দুঘণ্টা সময় এগিয়ে এসে শুরু হয় ভোর চারটের সময়। ১৯৩২-এর ‘বসন্তেশ্বরী’-র মধ্যে অনেক পরিমার্জন ও সম্পাদনা করে দেওয়া হয় নতুন রূপ। সংযোজিত হয় নতুন গান, স্তবস্তুতি। ক্যালেন্ডারে তিথির হেরফের অনুযায়ী পঙ্কজকুমার বৈচিত্র্য আনেন সুরসৃষ্টিতে। ‘বসন্তেশ্বরী’-তে সংগীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, চণ্ডীপাঠ করেন স্বয়ং বাণীকুমার। আর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (Birendra Krishna Bhadra)। অন্ধকার রাত্রি কেটে ঊষালগ্নে বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার যুগ-যুগান্তরের সাধনা পেল এক নতুন মাত্রা।

প্রথমদিকের অনুষ্ঠানে সংস্কৃত অংশের পাঠে বাংলা উচ্চারণের প্রবণতায় বারবার সমস্যায় পড়তেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। আজ, এত বছর পরে এসেও তাঁর আত্মমগ্ন, সুরেলা কণ্ঠের সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ শুনে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে এ কথা! অধ্যাপক অশোকনাথ শাস্ত্রী বেদান্ততীর্থ মহাশয়ের কাছে দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে পরিমার্জিত করে তোলেন সংস্কৃত উচ্চারণ। আর সেই বাকভঙ্গিমা থেকেই জন্ম নেয় আরেকটি ইতিহাস। তখনও চালু হয়নি রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা। মহড়ার দিনগুলিতে সকলেই চলে আসতেন স্টুডিওতে। ফাঁকে ফাঁকে চলত আড্ডা, গল্পগুজব। বাংলা ভাষ্য অংশটি তখন সুরের বদলে পাঠ করা হত স্বাভাবিক কথ্যভঙ্গিতে। বাণীকুমার বসে আছেন রেকর্ডিং রুমে। আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব কণ্ঠশৈলীতে চণ্ডীপাঠ করতে করতে বাংলা অংশটিও আচমকা পাঠ করতে শুরু করেন সুরেলা ভঙ্গিতে। নেহাৎই হালকা রসিকতা। রেকর্ডিং রুম থেকে ছুটে এলেন বাণীকুমার। চমকে গেলেন সকলেই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ হেসে জানালেন যে, একটু ‘মজা’ হয়ে গেছে ব্যাপারটা। বাণীকুমার শুনলেন না, ওইভাবেই পাঠ করতে বললেন তাঁকে। পুনরায় শুরু করলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, “দেবী প্রসন্না হলেন।” সেভাবেই পাঠ হল মূল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে। সেদিন স্টুডিওতে স্বর্গীয় পুষ্পবৃষ্টি হয়তো হয়নি, কিন্তু দেবী ‘প্রসন্না’ হয়েছিলেন নিশ্চয়ই।

আরও পড়ুন
মার্কনি সেট, রঘুবাবু ও মহালয়া

তাঁর উচ্চারণ নৈপুণ্য আরো বহুভাবে প্রভাবিত করেছিল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র অনুষ্ঠানকে। এমনিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ব্রাহ্মণসন্তান না হয়েও চণ্ডীপাঠ করায় একপ্রস্ত আলোচনা উঠেছিল বাতাসে। পঙ্কজকুমার বা বাণীকুমার কেউই পাত্তা দেননি সেই সময়ে। বরং বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে ব্রাহ্মণের চেয়েও বড়ো ব্রাহ্মণ বলেছিলেন বাণীকুমার। আবার যন্ত্রানুষঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম। সারেঙ্গি বাজাতেন মুন্সি, চেলোতে তাঁরই ভাই আলি আর হারমোনিয়ামে থাকতেন খুশি মহম্মদ। এছাড়াও ছিলেন আরো কয়েকজন। সমস্যা হচ্ছে এঁরা সুরটা বুঝলেও বাংলাটা ভালো জানেন না অনেকেই। প্রথমে ঠিক ছিল বাংলা গ্রন্থনাপাঠের ফাঁকের শূন্য আবহ পূরণ করা হবে যন্ত্রসঙ্গীতের সাহায্যে। সেই অনুযায়ী শুরু হল অনুষ্ঠান। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সংস্কৃত শ্লোকপাঠ শেষ করে শুরু করলেন বাংলা গদ্য আবৃত্তি। কিন্তু উর্দুভাষী বাদকরা টের পেলেন না ভাষা পরিবর্তনের পার্থক্য। দিব্যি বাংলা গদ্যপাঠের সুরে বাজিয়ে চললেন বাজনা। রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখরা তো সম্পূর্ণ বিস্মিত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ কিন্তু থামলেন না। চলতে লাগল ওইভাবে। কিছুক্ষণ পরে তাল মেলালেন বাঙালি যন্ত্রীরাও। পুরো ব্যাপারটি যেন বাঁধা পড়ে গেল এক লয়ে, এক ছন্দে।

আরও পড়ুন
নব্বইয়ের মহালয়া, রেডিও নয় তবু নস্টালজিয়া

১৯৬২ পর্যন্ত প্রতিবছরই সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। শুধু ১৯৪৬-এ ভারতের স্বাধীনতালাভের আগের বছর দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল রেকর্ডের মাধ্যমে। সে রেকর্ডের কোনো হদিশ নেই আজ। মাত্র এক-দেড় মাস ধরে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক সমস্যার পরে এক শরতের সকালে ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ শুনতে বঙ্গবাসীর কেমন লেগেছিল, তার বর্ণনার খোঁজ পাওয়াও হবে এক আশ্চর্য সম্পদ। অবশেষে চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে বাজেটে টান পড়ায় বাজানো হতে শুরু করে রেকর্ড। পরের তিনবছরও চলে একই ধারা। ১৯৬৬ থেকে দেশে জরুরি অবস্থা জারি পর্যন্ত চারবার হয়েছে নতুন রেকর্ডিং। এরই মধ্যে ১৯৭০-এ অবসর নেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। শেষ হয় বেতারে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সম্প্রচারের এক বিরাট যুগ।

সময় কেটে গেছে নিজের স্রোতে। একই সঙ্গে অতীতচারিতা আর ইতিহাসবিমুখতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ বাঙালির মধ্যে। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন বেসরকারি রেডিও চ্যানেলেও বেজে ওঠে ‘মহালয়া’। কিছু না হলে ইউটিউব তো রয়েছেই। হয়তো চণ্ডীপাঠের সেই পবিত্রতার সংযোগসূত্রেই বেজে ওঠে বিজ্ঞাপন। তবু যেন এক মাদকতা, একবার ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা নিজের শিকড়কে। সারা বছর কেটে যায় বিশ্বায়নের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে, পুজোর এই কদিন যেন সত্যিই ঘরের ছেলের ঘরে ফেরার পালা। মহালয়ার সকালে বেজে ওঠা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ তো তারই আবাহন। 

ঋণস্বীকার : কলকাতার বেতারে মহালয়া, মিহির বন্দ্যোপাধ্যায়
বীরেন্দ্রকৃষ্ণের আলোর রেণু, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, কলকাতা বেতার

Powered by Froala Editor