২৯ আগস্ট, ১৯৩০। ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতাল সেদিন পুলিশে ছয়লাপ। কী ব্যাপার? পুলিশের ইনসপেক্টর জেনারেল মি. লোম্যান এসেছেন হাসপাতালে। সঙ্গী ঢাকার পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট মি. হাডসন। এই সেই হাডসন সাহেব, যাঁর আদেশে এক মাস আগে নৃশংস লাঠিচার্জ করা হয়েছিল নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিলে। মারা গেছিল একজন, আহত বহু। আর চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনার পর থেকে লোম্যানের ভয়ানক রূপ দেখেছে গোটা বাংলা। এবার সময় এসেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার। কিন্তু পুলিশের কড়া পাহারা ভেদ করে কীভাবে সেখানে পৌঁছোবে বিপ্লবীদের বন্দুক? আর যিনি এই দায়িত্ব নেবেন, তাঁর বন্দি হওয়া একেবারে নিশ্চিত।
তা বলে কি এত বড়ো সুযোগ হাত থেকে ছাড়া যায়? বিপদ থাকবে, সেটা তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। সে-সব জেনেই তো কলকাতা থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন বিনয় বসু (Benoy Basu)। লক্ষ ঠিক করে দিয়েছিলেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের অন্যতম নেতা ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত রায়। হয় গভর্নর, নতুবা লোম্যান। কোনো একজনের শাস্তি চাই-ই চাই। আপাতত লোম্যানকে পাওয়া গেছে হাতের নিশানায়। যে নিশানা কখনই ভুল হয় না। রেবতীমোহন বসুর পুত্র তিনি। যাঁর বন্দুকের গুলির লক্ষ্য ছিল অব্যর্থ। এবার পুত্র বিনয় বসুর উপর দায়িত্ব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন পথ সন্ধানের।
অস্ত্র লুকিয়ে রাখা ছিল ঢাকার আরমানি টোলায়। কলকাতা থেকে এসে রিভলভার দিয়ে গেছেন উজ্জ্বলা মজুমদার ও তাঁর পিতা সুরেশ মজুমদার। ২৯ আগস্ট মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজে এসে গেল সেই অস্ত্র সদ্ব্যবহারের সুযোগ। এই কলেজেরই ছাত্র বিনয়। ওই তো, অসুস্থ মি. বাডকে দেখে ফিরছেন লোম্যান আর হাডসন। না, আর দেরি নয়। গর্জে উঠল পিস্তল। কোনো ভুল হয়নি। ওই যে, মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন দুই সাহেব। শোনা যাচ্ছে উদভ্রান্ত পুলিশের তৎপরতার শব্দ। এই গণ্ডগোলের ভিতরেই নিঃশব্দে সরে পড়ে উচিত।
কিন্তু একজনের নজর এড়াতে পারলেন না বিনয়। কোনো ব্রিটিশ পুলিশ নয়, সত্যেন সেন নামের এক বাঙালি। পেশায় কনট্রাক্টর। ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশার সুবাদে ভালোই ব্যবসা চলছিল তাঁর। কাল হল বিনয়কে ধরতে গিয়ে। তাঁর এক ঘুষিতে ইহলোকের যাবতীয় কার্যকলাপ শেষ হল সত্যেনের। আর হাসপাতালের পাঁচিলের পথ ধরে, পাশের বাড়ি দিয়ে দিব্যি নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যান বিনয়।
আরও পড়ুন
‘অলিন্দ যুদ্ধ’-র আগের দিন রাইটার্সে বাদল গুপ্ত, ছকে নিলেন মানচিত্র
অবশ্য ঢাকা শহর যে আর তাঁর নিরাপদ থাকবে না, সেটা তিনি ভালো করেই জানতেন। কলেজের ছাত্রদের জেরা করে পুলিশের কাছে চলে এল বিনয়ের নাম। শুরু হল সমগ্র ঢাকা জুড়ে চিরুনিতল্লাশি। লোম্যানের হত্যাকারী বিনয় বোসের নামে ধার্য করা হল নগদ দশ হাজার টাকা পুরস্কার। কিন্তু কী আশ্চর্য! সারা শহর যেন এই একটা বিশেষ ক্ষেত্রে মৌনব্রত পালন করতে শুরু করেছে। চলল সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার। কমবয়সী যুবক দেখলেই থানায় আটকে রেখে চলে নির্যাতন। বাদ গেলেন না মহিলারাও। কিন্তু এত কিছু করেও কোনোভাবেই বিনয়ের খোঁজ পেল না ইংরেজ পুলিশ।
আরও পড়ুন
ইংরেজ-হত্যার জন্য হারমোনিয়ামে অস্ত্র পাচার, ছদ্মবেশে পুলিশকে ধোঁকা বিপ্লবী উজ্জ্বলার
বিনয় তখন সঙ্গতটোলার শশাঙ্ক দত্তের বাড়িতে। সঙ্গী হিসেবে রয়েছেন আরেকজন। ঘটনাচক্রে তাঁরও নাম বিনয় বসু। অন্তত কয়েকটা রাত এক সঙ্গে থাকতে হবে। দ্বিতীয় বিনয়ের উপর যাবতীয় দায়িত্ব প্রথম বিনয়ের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। পুলিশকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এই অভিনব বুদ্ধিটি বেরিয়েছিল সুপতি রায়ের মস্তিষ্ক থেকে। আর সেই সময়ে অর্থ সাহায্য করেছিলেন ঢাকার শ্রী সংঘের বিপ্লবী লীলা নাগ।
তবু ঢাকা শহর আর কোনোভাবেই নিরাপদ নয় বিনয়ের জন্য। জোরদার পাহারা সত্ত্বেও যেভাবেই হোক পালাতে হবে এখান থেকে। প্রথম গন্তব্য নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে কলকাতা। সেদিন প্রবল বর্ষা। রাস্তাঘাট জলে ভেসে যাচ্ছে। পুলিশি পাহারাও খানিক শিথিল। জনহীন রাস্তায় দেখা গেল শুধু দুজন গ্রাম্য মুসলিমকে। পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি আর ময়লা গেঞ্জি। দুজনের নামই বিনয়। পুলিশকে বজ্র আঁটুনিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে দিব্যি তাঁরা উঠে পড়লেন নারায়ণগঞ্জ-গামী ট্রেনে। চলন্ত গাড়িতেও অবশ্য পুলিশি তল্লাশি হয়েছিল। কিন্তু না, বিনয় বসু বলে কোনো ‘অপরাধী’-র সন্ধান পায়নি পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জ থেকে বিদায় নিলেন দ্বিতীয় বিনয়। হয়তো ইতিহাস একজনকেই মনে রেখেছে তাঁর কীর্তির জন্য। তবু সমনামের আরেক বিপ্লবীও দায়িত্ব সহকারে পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন সেই কীর্তির। যাই হোক, বহু বাধা অতিক্রম করে বিনয় ও সুপতি এসে পৌঁছোলেন কলকাতায়। পথে দু-তিনবার ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়েছে। অভিনয় করতে হয়েছে বহুবার। কিন্তু কলকাতাই-বা কতটা নিরাপদ বিনয়ের জন্য? এখানেও বেশ কয়েকটি গোপন আস্তানায় হামলা করল পুলিশ। সেই পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বে স্বয়ং কমিশনার চার্লস টেগার্ট।
জরুরি মিটিং বসল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের নেতাদের মধ্যে। যেভাবে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাতে বেশিদিন নিরাপদে রাখা যাবে না বিনয়কে। প্রাণের ভয় তাঁরা কেউই করে না, কিন্তু কাউকে যেচে ব্রিটিশ সিংহের মুখে ঠেলে দেওয়ার পক্ষপাতী নয় তাঁরা। উপায় একটাই। বিনয়কে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া। স্বয়ং সুভাষচন্দ্র পর্যন্ত সম্মতি দিলেন এই সিদ্ধান্তে। বিদেশে যাওয়ার অর্থের জোগান দিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং অবলা বসু।
কিছুদিন পরে ভোর পাঁচটায় একটি জাহাজ রওনা দিল কলকাতা থেকে। একজন যাত্রী নিশ্চিতভাবেই কম ছিল সেখানে। দলের নেতারা যা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুন না কেন, বিদেশে ‘পালিয়ে’ যাবেন না বিনয়। মৃত্যুবরণ করতে হলে নিজের দেশে বীরের মতো লড়াই করে মরবেন। সেই সুযোগও মিলল কিছুদিন পরে। রাজেন গুহের বাড়িতে আলাপ হল দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে। এসে পড়লেন বাদল গুপ্তও। তৈরি হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর বিপ্লবী জুটি বিনয়-বাদল-দীনেশ।
১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করলেন তিনজন। ঐতিহাসিক ‘অলিন্দ যুদ্ধ’-এ ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন বাদল। গুরুতর আহত অবস্থায় বন্দি হন বাকি দুজন। দীনেশ গুপ্ত শহীদ হন ফাঁসির দড়ি বরণ করে নিয়ে। আর বিনয়? ব্রিটিশ পুলিশের ক্ষমতা ছিল না তাঁকে শাস্তি দেওয়ার। অচেতন বিনয়ের হাতের আঙুল ভেঙে দিয়ে হয়তো বহুদিনের পুষে রাখা আক্রোশ মেটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন টেগার্ট। কিন্তু ওইটুকুই সার। ১৩ ডিসেম্বর মাথার ব্যান্ডেজ ভেদ করে ক্ষতস্থানে হাত ঢুকিয়ে দেন বিনয়। আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে। অবশেষে ধরা দিলেন বিনয়। মৃত্যু নামের এক বহু আকাঙ্ক্ষিত বন্ধুর কাছে। যাওয়ার আগে ফের একবার বোকা বানালেন ব্রিটিশ পুলিশকে। এতই কি সহজ বিনয়কে শাস্তি দেওয়া?
Powered by Froala Editor