১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অলিন্দ ধরে পথ হাঁটছিলেন ওরা তিনজন। দূরে হয়তো কোথাও উড়ছে ইউনিয়ন জ্যাক। একবার কি চোখ পড়ল সেদিকে? আর কিছুদিন, তারপরই ভারতের মাটি থেকে চিরতরে বিদায় নেবে ইংল্যান্ডের জাতীয় পতাকা। অত্যাচার আর নিপীড়নের যে কালো ইতিহাস প্রতিদিন-প্রতিমুহূর্তে লেখা হচ্ছে ইংরেজের বন্দুক-বেনোয়াটে, তার সময়কাল প্রায় শেষ। না, গান্ধীজির মতো অহিংস সত্যাগ্রহের পথ তাঁরা চান না। স্বদেশি আন্দোলনের পরিকল্পনার ব্যর্থতা দেখেছেন তাঁরা। এবার শেষ কথা বলবে অস্ত্রের গর্জন। ইংরেজের চোখে চোখ রেখে ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে। ভারতীয়রা শুধু আর পড়ে পড়ে মার খাবে না। সময় এসেছে প্রত্যাঘাতের। চট্টগ্রামে সূর্য সেন করেছেন। সুভাষচন্দ্র বসু প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন ‘বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স’-এর মাধ্যমে।
বিনয়-বাদল-দীনেশ। রাইটার্সের অলিন্দ ধরে হাঁটছেন তিনজন। সামনেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল মি. সিম্পসনের ঘর। তাঁদের মূল লক্ষ্য। পর পর রয়েছে টোয়াইনাম, নেলসন আর প্রেন্টিসের ঘর। শুধুই কয়েকজন ইংরেজ অফিসারকে হত্যা করা নয়। আসল উদ্দেশ্য একটা বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার। সমস্ত ভারতবাসীর পক্ষ থেকে। ধোপদুরস্ত সাহেবি পোশাক পরা তিন যুবককে সন্দেহের অবকাশই পেল না কেউ। এঁদের মধ্যে বিপ্লবীকর্মে সবচেয়ে অভিজ্ঞ বিনয় বোস (Benoy Basu)। ইনস্পেক্টর জেনারেল লোম্যান হত্যায় জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। আর মেদিনীপুরে ডগলাস, বার্জ সাহেবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন দীনেশ গুপ্ত (Dinesh Gupta)।
এঁদের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য বাদল গুপ্ত (Badal Gupta)। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই প্রস্তুত হয়েছেন দেশমাতৃকার সেবায় জীবন উৎসর্গ করার জন্য। আসল নাম অবশ্য সুধীর গুপ্ত। শৈশব-কৈশোর কেটেছে ঢাকার বিক্রমপুরে। স্কুলশিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সংস্পর্শে তাঁর মধ্যে জাগরিত হয় স্বাধীনতার স্বপ্ন। জহর চিনতে ভুল করেননি নিকুঞ্জবাবু, কারণ দেশপ্রেমের রক্ত বাদলের শরীরে প্রবাহিত ছিল জন্মসূত্রেই। আলিপুর বোমা মামলায় দণ্ডিত হয়েছিলেন তাঁর দুই কাকা। সেই রাজনৈতিক পরিবেশেই তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা। কথা নয়, কাজই ছিল শেষ কথা। নীরবে সমাধা করে দিতেন যাবতীয় দায়িত্ব।
১৯২৯ সালের কথা। বাদল তখন ‘বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স’-এর সক্রিয় সদস্য। উপরমহল থেকে নির্দেশ এল ঢাকা-বিক্রমপুরের টেলিগ্রামের তার কাটতে হবে। অথচ হাতে সময় খুব কম। কে নেবে এই ঝুঁকির দায়িত্ব? সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মিলল বাদল গুপ্তের নামে। দুয়েক দিনের মধ্যে বিক্রমপুরে লোহার থামগুলি দাঁড়িয়ে রইল বোকার মতো। উধাও হয়ে গেছে লাইনের তার। এ কাজ যে একজনের পক্ষেই করা সম্ভব, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না পুলিশের। কিন্তু তাঁকে আর পাবে কোথায়? বাদল তখন বিক্রমপুর থেকে বহু দূরে।
আরও পড়ুন
বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে চ্যাপলিনের সিনেমা দেখেছেন ভানু, করেছেন গুপ্তচরের কাজও
ততদিনে শুরু হয়ে গেছে সিম্পসন হত্যার প্রস্তুতি। বন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর নৃশংস অত্যাচারের জন্য কুখ্যাত ছিল যার নাম। দায়িত্ব বর্তাল ঢাকার তিন যুবকের উপর। ইতিহাসের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর অঙ্গুলিহেলনে মহাকালের পাতায় অবিচ্ছেদ্য হয়ে রইল তিনটি নাম। বিনয়-বাদল-দীনেশ। দিন ঠিক হল ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর। সময় দুপুর ১২টা। কলকাতা তথা ভারত কেঁপে উঠবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে। ভূকম্পের আঁচ পৌঁছোবে ইউরোপের এক রাষ্ট্রেও। তার সমস্ত পরিকল্পনা প্রস্তুত। অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়ে গেছে। টেবিলে ছড়ানো নিঁখুত নকশা।
আরও পড়ুন
‘পরলোকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করিব’, ফাঁসির আগের দিন মা-কে লিখলেন দীনেশ
কিন্তু একটি বিষয় নিয়ে অস্বস্তি ছিল নিকুঞ্জ সেনের। নকশা থেকে পাওয়া জ্ঞান আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে বিস্তর ফারাক। অন্তত একজনের উচিত সরেজমিনে পরীক্ষা করে আসা। কিন্তু ‘অ্যাকশন’-এর আগের দিন বাঘের গুহায় ঢুকবে কে? বিনয়ের নাম প্রথমেই বাদ দেওয়া যায়। পুলিশের কাছে তাঁর বিবরণ থাকা খুবই স্বাভাবিক। দীনেশ একেবারে বারুদের স্তূপ। সিম্পসনকে সামনে পেলে হয়তো ৭ তারিখই কিছু একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবেন। অতএব দায়িত্ব পড়ল বাদলের উপর। এবারও কোনো কথা নয়। একজন পরিচিত কর্মচারীর সঙ্গে গোটা রাইটার্স বিল্ডিং ঘুরে এলেন তিনি। মাথায় আঁকা রইল সম্পূর্ণ ম্যাপ। ফেরার পথে একটি ছোটো অনুরোধ রাখলেন তিনি। একবার যদি কাকা তরণীনাথ গুপ্তের বাড়িতে ঘুরে আসা যায়। দলীয় নির্দেশ উপেক্ষা করেই সেদিন বাদলের অনুরোধ রেখেছিলেন নিকুঞ্জবাবু। রাস্তা থেকে ছোটো বোন মৃদুলার জন্য কিনেছিলেন চিনামাটির পুতুল। পরিবারের লোকেরা হয়তো জানতেও পারেননি, এই ছিল শেষ দেখা। এই পুতুলই তাঁর তরফ থেকে শেষ উপহার।
কিন্তু যাঁরা জানতেন? মানে নিকুঞ্জ সেন, রসময় শূর, রাজেন গুহ এবং তাঁর স্ত্রী। তাঁদের বাড়িতেই আগের রাতে ছিলেন বাদল আর দীনেশ। ৮ তারিখ সকালে এক থমথমে নীরবতায় ঘর ছাড়লেন তাঁরা। শেষবারের মতো। খিদিরপুরের মোড়ে ট্যাক্সি বদলানো হল। সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন রসময় শূর আর নিকুঞ্জ সেন। কালো ধোঁয়া ছেড়ে রওনা দিল আরেকটা ট্যাক্সি। কিন্তু কেন সব কিছু ঝাপসা ঠেকছে? বিপ্লবীর চোখে জল কি মানায়? সবই জানতেন নিকুঞ্জ ও রসময়। স্বান্ত্বনা বলতে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে আজ, একটু পরে।
যার রচয়িতা বিনয়-বাদল-দীনেশ। আর ফেরেননি তাঁরা। সিম্পসন হত্যার পর কমিশনার টেগার্টের বাহিনী ঘিরে ফেলে তিনজনকে। গুরুতর জখম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও, স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথ বেছে নেন বিনয়। ফাঁসির সাজা বরাদ্দ হয় দীনেশ গুপ্তের জন্য। আর বাদল? ব্রিটিশের পুলিশের কাছে ধরা দেবেন না। পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। বিচারের নামে প্রহসন তাঁকে দেখতে হল না। সেই মৃত্যুর সাজাই অপেক্ষা করত তাঁর জন্য। বিপ্লবী জীবনের সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজের স্বাধীনতায়। মৃত্যু? তার জন্যই তো এত অপেক্ষা। সেই পবিত্র অধিকারই বা কেন অন্যের হাতে ছাড়বেন বাদল গুপ্ত?
Powered by Froala Editor