“অন্য অনেক দেশে দুর্গাপুজো হয় সপ্তাহ শেষে। এখানে কিন্তু সেরকম নয়। রীতিমতো তিথিনক্ষত্র মেনে পুজো হয় এখানে। এবং প্রবেশ অবাধ। দেশ-বিদেশের সবার অবারিত দ্বার। এই কটা দিন যেন এক টুকরো বাংলাকে এনে দেয় আমাদের জীবনে।”
বলছিলেন আত্রেয়ী বসু। চাকরিসূত্রে স্বামী ও নয় মাসের কন্যাসহ ফ্রান্সের (France) প্যারিসেই (Paris) ঘরকন্না তাঁর। গত তিন বছর সেখানেই কেটেছে শরতের দিনগুলি। প্রতিবারই চেষ্টা করেন পুজোর সময় ঘরে ফেরার। পেশাগত ব্যস্ততায় হয়ে ওঠে না কোনোভাবেই। কিন্তু তাই বলে কি দূরে থাকা যায় উৎসবের আনন্দ থেকে? যতই হোক, মনে-প্রাণে তো বাঙালি। আর বাঙালি বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, ঠিক আয়োজন করে নেবে দুর্গাপুজোর। প্যারিসেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আত্রেয়ী-অভিজ্ঞানও জড়িয়ে পড়েছেন ‘সম্মিলনী’-র সঙ্গে। শুধু তাঁরা নয়, পুজোর কটা দিন সেখানকার বাঙালিরা একত্রিত হয়ে মেতে ওঠেন আনন্দোৎসবে।
১৯৮৭ সালে প্যারিসে বসবাসকারী বাঙালিদের উদ্যোগে শুরু হয় সম্মিলনীর পুজো। কলকাতা থেকে নিয়ে আসা হয় ফাইবারের ঠাকুর। তারপর থেকে প্রতিবছর সিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডিয়া হাউসের কমিউনিটি হলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুর্গাপুজোর। প্যারিসে আরো কয়েকটি পুজো হলেও সম্মিলনীর পুজোই সেখানকার সবচেয়ে প্রাচীন। ষষ্ঠীর বোধন থেকে বিজয়ার সিঁদুরখেলা, সব হয় রীতি মেনে। অষ্টমীতে থাকে ভোগের আয়োজন। প্রায় ২০০-৩০০ মানুষের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাপনার সবটাই করে সম্মিলনীর সদস্যরা।
সভাপতি রুবি দত্ত এবং সহ-সভাপতি পিন্টু পালের ব্যবস্থাপনায় দিনকে দিন আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে এই পুজো। আলাদা করে বলতে হয় কোষাধ্যক্ষ পবিত্র দাসের কথাও। শুধু বাঙালি তো নয়, বিদেশিরাও আপন করে নিয়েছে দুর্গাপুজোকে। অনেকেই বিবাহসূত্রে প্রায় ‘বাঙালি’ হয়ে উঠেছেন, অনেকে আবার নিছক ভালোবাসার টানেই যুক্ত থাকেন পুজোতে। অভিজ্ঞান বলছিলেন লিলিয়ানের কথা। অশীতিপর এই মহিলা যৌবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন ভারতে। সম্মিলনীর সঙ্গেও যুক্ত দীর্ঘদিন। প্রতি বছর নিজের হাতে বানান পুজোর মালা। এছাড়াও নিয়মিত লেগে থাকে বিদেশি বন্ধুদের ভিড়।
আরও পড়ুন
দশঘড়ার বিশ্বাস পরিবারের দুর্গাপুজো
আর পুজো মানে তো শুধু চারটে দিন নয়, সেই জুলাই থেকে শুরু হয় তোড়জোড়। কয়েকদফা মিটিংয়ের পর আগস্ট থেকে চলে রিহার্সালের পালা। এই দু’মাস অফিসের খাটনির পর সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে হাজির হয় সবাই। আর পুজোর সন্ধ্যাগুলি ভরে থাকে নাচ, গান, আবৃত্তিতে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দারাও অংশগ্রহণ করে। ষষ্ঠীর দিন থাকে ‘বসে আঁকো’। না, প্রতিযোগিতা নয়। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানুষ অংশগ্রহণ করে তাতে।
আরও পড়ুন
১৮৩ বছরে রামকৃষ্ণ-স্মৃতিধন্য কুমোরটুলির গঙ্গাপ্রসাদ ভবনের দুর্গাপুজো
“এই পুজোটা আসলে প্যারিসের বাঙালিদের প্রাণভোমরা। এত দূরে থেকেও এই কয়েকটা দিন সবাই নিজের শিকড়কে আঁকড়ে ধরতে চায়।” বলছিলেন আত্রেয়ী। এ প্রসঙ্গে উঠে এল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাঁদের সন্তানরা বড়ো হচ্ছে দেশ থেকে বহু দূরে। যাদের অনেকেই কোনোদিন চাক্ষুষ করেনি বাংলার দুর্গাপুজো। সেই নতুন প্রজন্মের জন্যই আরো বেশি করে প্রয়োজন পড়ে এই আয়োজনের। দুর্গাঠাকুরকে চিনতে শেখে তারা, শোনে পুরাণের গল্প। শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবি পরে সন্ধের আসরে গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর অবশ্যই সাক্ষী থাকে পাত পেরে খিচুড়ি খাওয়ার। গতবছরের মতো এবারও অভিজ্ঞান নাটক করাচ্ছে শিশুদের নিয়ে।
অবশেষে দশমীতে সিঁদুর খেলা, ধুনুচি নাচ, মিষ্টিমুখে শেষ হয় উৎসব। বিদেশযাপন বলে এখন আর মনে হয় না, প্যারিসই তাঁদের ঘরবাড়ি। আর এই পুজোটা সবার বাড়ির পুজো। বড্ড কাছে এনে দেয় বাংলার নদী-মাঠ-কাশফুলকে। তবু কি একটা চেনা ব্যথা বেজে ওঠে না ঢাকের শব্দে? রোদ ঝলমলে প্যারিসের সকালে অফিসমুখী ভিড়ের ব্যস্ততার মধ্যে আকাশের দিকে তাকালে নিশ্চয়ই মনে পড়ে কলকাতার কথা। অস্বীকার করেন না আত্রেয়ী, “ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে আসে প্রতিবছর। কত সংসারে আলো ভরে ওঠে। হয়তো এই দুর্গা বাড়ি ফিরতে পারে না, তাই এই দূর দেশেই একটা ছোট্ট কোণায় নিজের মতো একটা ছোট্ট বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে। আমার মতো এখানের সব বাঙালিই সেখানে মা দুর্গাকে লালন করে। তিনি তো জগতের মা। এখানেও আমাদের সঙ্গেই আছেন তিনি।”
কথাটা বলার সময় সামান্য অস্পষ্ট শোনায় তাঁর গলা। কারণটা আর বলার দরকার পড়ে না। পুজো আসছে এই অনুভূতিটাই তো সব। কটা দিন পরেই জীবন ফিরে যায় পুরনো খাতে। আবার অপেক্ষা একটা বছরের। ভিতরে ভিতরে শুরু হয় দিন গোনা। মনের মধ্যে গুনগুন করে ওঠে সেই চেনা ধ্বনি, “আসছে বছর আবার হবে!”
Powered by Froala Editor