১৮৩ বছরে রামকৃষ্ণ-স্মৃতিধন্য কুমোরটুলির গঙ্গাপ্রসাদ ভবনের দুর্গাপুজো

যে দরজা দিয়ে কুমোরটুলি স্ট্রিটের এই বাড়িতে ঢুকতে হয়, তার পাশের দেওয়ালে সাদা মার্বেলের উপর খোদাই করা— ‘ঠাকুরের দেহে ব্যাধি চিন্তিত নিরবধি/ মথুর মাথায় রাখে হাত/ রোগারোগ্য বাসনায় দেখাইতে আসে তাঁয়/ রুগী সাজে জগতের নাথ।’ সালটা ১৮৫৮। রানি রাসমণির জামাতা মথুরবাবুর আহ্বানে শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসা ভার গ্রহণ করলেন গঙ্গাপ্রসাদ। ধন্বন্তরি গঙ্গাপ্রসাদ দেখে বুঝলেন, এ যোগজ ব্যাধি! সারবার নয়। লেখা আছে সেই কথাও— ‘যোগজ ইহাকে বলে এই রোগ শুধু ছলে/ নিরাময় হইবার নয়।’

ঢাকা জেলার উত্তরপাড় কোমরপুকুর গ্রামের বাসিন্দা বদ্যি নীলাম্বর সেন। তাঁর ইচ্ছে, ভাগীরথীর ধারে জীবনের শেষ দিনগুলি কাটাবেন। কলকাতায় আসা-যাওয়ার সুবাদে দুর্গাচরণ লাহার সঙ্গে পরিচয় তাঁর। অবশেষে দুর্গাচরণ ও তাঁর পুত্র নবকৃষ্ণ দেবের বংশধর অভয়কৃষ্ণ দেবের বদান্যতায় নীলাম্বরের আটচালা ওঠে কুমোরটুলির গঙ্গাপাড়ে।

সাল ১৮৪০। কুমোরটুলি স্ট্রিটের সেই পথে ডোবা। স্যাঁতসেঁতে পথের পোশাকে পোড়া ইট। বিবর্তনের কথা সকলেই জানেন কম-বেশি। যা জানেন না, নীলাম্বর মহাশয় নিজের অন্তর্জলি করেছিলেন। গঙ্গায় শরীর চুবিয়ে অপেক্ষা মহামৃত্যুঞ্জয়ের। পুত্র গঙ্গাপ্রসাদকে (১২৩১-১৩০২) আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পাঠ দেন। গঙ্গা সাক্ষী। আশিস দিয়ে পুত্রকে বলেন, ‘তুমি হাল ধরো চিকিৎসার। শুরু করো তোমার কবিরাজি। জগৎ বিখ্যাত হবেই।’ ১৮৪২ সাল। প্রয়াণ নীলাম্বরের।

আজ থেকে বছর দশ আগে কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো বলছিলেন সতীপ্রসন্ন সেন। তাঁর বয়স ৮৪ পেরিয়েছে। সেন বংশের শেষ উত্তরাধিকার তিনি। আজ ২০২৩-এ তাঁদের বাড়ির দুর্গা পুজোর বয়স ১৮৩। বাড়ির দালানে ১৮৪০-এ শুরু করেছিলেন নীলাম্বর সেন।

আরও পড়ুন
বাঙালির ‘মাই’ ও কিছু টিপ্পনী

এরপর পাকা হয় বাড়ি। পুজো চলতে থাকে রমরমিয়ে। ইতিমধ্যে সিপাহি বিদ্রোহ শেষ হয়ে গিয়েছে। বদ্যি গঙ্গাপ্রসাদ সেনের কথা ইংরেজদের জানা ছিল। শোনা যায়, উনিশ শতকের শেষের দিকে ভিক্টোরিয়া-নন্দন প্রিন্স অব ওয়েলস রাজধানী কলকাতায় দরবার করেছিলেন। কিছুদিন পরেই ওয়েলসের নিদ্রাহীন রোগ হয়। গঙ্গাপ্রসাদের টোটকায় তিনি সেরে ওঠেন। তারপর থেকে ইংরেজরা এই বাড়ির দুর্গা পুজোর সময় নিয়মিত আসা-যাওয়া। তাদের জন্য সপ্তমীর দিন দোতলার হলঘরে বল-ড্যান্সের আসর বসত।

আরও পড়ুন
মা গুপ্তমণি মন্দির: ৪৫০ বছর ধরে চলে আসছে শবরদের দুর্গাপুজো

গঙ্গাপ্রসাদ ভবনে পুজো তন্ত্রমতে। মহালয়ার এক সপ্তাহ আগেই শুরু উপাচার। চৌষট্টি যোগিনী আসন পাতা হয় দেবী বন্দনার জন্য। সপ্তমী-অষ্টমী সন্ধিপুজোয় অজিতা ও অপরাজিতা পুজো পান। দশভুজা হয়েও দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে পরাভূত করার শক্তি পাচ্ছিলেন না। ডেকে নিয়েছিলেন ভয়ংকরী দুই কালীশক্তি অজিতা ও অপরাজিতাকে। কালিকাপুরাণে এই কথা পাওয়া যায়। যাই হোক, অষ্টমীর দিনই ভাসান হয় কালীমূর্তির। তারপর শুরু হয় অষ্টমী পুজো।

মৃন্ময়ী একচালার। হারু পাল চারপুরুষ ধরে গড়ছেন প্রতিমা। বাঁ-দিকে গণেশ। এটাই পরম্পরা। ভগবতী ‘শ্রী’ আর ‘ধী’ অর্থাৎ সমৃদ্ধি ও বুদ্ধির যুগ্ম প্রতিরূপে তিনি বামা। গণেশের উপস্থিতিও তাই বাঁ-দিকে। দশমীর দিন বড় গঙ্গাজলের গামলায় দর্পণে ছায়া দেখে প্রতিমা বিসর্জন হয়। আদি রীতি এটি।

ফেরার পথে দোতলার সেই বিরাট হলঘরে কান পাতি। অনুভবে অপেরা সংগীত। সপ্তমীর দিন সাহেবসুবোরা যেন আজও আসেন। পুজো দেখেন। যাত্রা হয়। তবে পুজোর সেই জৌলস আজ আর নেই। স্মৃতির ভিড়ে ইতিহাস এখানে ফিকে হলেও বিস্মৃত নয়।

Powered by Froala Editor