গঙ্গাভাগের সাক্ষী কাশিমবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো

প্রায় ৩০০ বছর আগেকার কথা। বাংলার ভগবানগোলা তখন বর্ধিষ্ণু বাণিজ্যনগরী। ব্যবসা-বাণিজ্যে ফুলেফেঁপে ওঠা এক শহর। বন্দরে এসে ভেড়ে বহু দেশি-বিদেশি জাহাজ। তবে বাংলায় বর্গিহানার পর বন্ধ হয়ে যায় এই বন্দর। সেই সময় ভগবানগোলা লাগোয়া পিরোজপুর গ্রামে ছিল রায়দের ভিটে। সেখানেই মহাসমারোহে প্রতিবছর দুর্গাপুজো। ভগবানগোলা বন্দরটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে, তারা বাধ্য হয়ে পৈতৃক ভিটে ছেড়ে চলে আসেন বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজারে। এখানে ১৭৩০ সালে স্থাপিত হয় মহল। কাশিমবাজার (Cossimbazar) বন্দরনগরী। বহু বাণিজ্য জাহাজ ইউরোপসহ পৃথিবীর বহু প্রান্তে ব্যবসা করতে যেত। রায় বংশের পূর্বপুরুষরা আবারও ব্যবসা শুরু করে প্রতিষ্ঠালাভ করেন। মূলত রেশমের আমদানি-রপ্তানি চলত। এর সঙ্গেই পিরোজপুরে যেমন রায়দের ভিটেতে দুর্গাপুজো হত, কাশিমবাজার এসেও সেই পুজোর চল বহাল থাকল।

১৭৫৭-তে পলাশির যুদ্ধের পর বাংলায় জাঁকিয়ে বসে ব্রিটিশরা। ১৭৮০-তে তারা কাশিমবাজারের নদীপথটি বন্ধ করে দেয়। গঙ্গা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদের পাশ দিয়ে বয়ে যায় ভাগীরথী গঙ্গা এবং কাশিমবাজারের পাশ দিয়ে একটি সরু খাল, যার নাম কাটি গঙ্গা। সময়ের পরিহাসে খাল শুকিয়ে এলে কাশিমবাজার বাণিজ্যবন্দরটিও বন্ধ হয়ে যায়, সেইসঙ্গে রায়দের ব্যবসাও। রায়বাড়ির পূর্বপুরুষ জগবন্ধু রায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর আমলেই ধীরে ধীরে কাশিমবাজার রায়বাড়ির জমিদারি বিস্তার লাভ করে। বংশ পরম্পরায় রায়বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হয়। নতুন মহল গড়ে ওঠে। রাজবাড়ির বর্তমান যে প্রধান ফটক, নির্মিত আনুমানিক ১৮৫০ সালে। তৈরি করেছিলেন নৃসিংহপ্রসাদ রায়। ফটকের পর বাগান এবং একটি সুদৃশ্য মহলও এখন বিদ্যমান। এই মহলে আধুনিক কনফারেন্স রুম রয়েছে। পিছনে রায়বাড়ির সদস্যদের থাকার জায়গা। আধুনিকতার প্রয়োজন অনুযায়ী রায়বাড়িতে নতুন মহল গড়ে উঠেছে। ১৭৩০-এ তৈরি প্রথম মহলটি এখনও ইতিহাসের সাক্ষী। ভূমিকম্পে কিছু মহলে ক্ষতি হলেও রায়বাড়ির কোনও ক্ষতি হয়নি।

পিরোজপুরের পর কাশিমবাজারে এসে ১৭৪০ সালে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন অযোধ্যারাম রায়। কাশিমবাজার আসার পর বাগানের পঞ্চমুণ্ডি আসনে প্রথম দুর্গাপুজো। পরে চণ্ডীমণ্ডপ নির্মিত হয় এবং বর্তমানে এই চণ্ডীমণ্ডপেই দুর্গাপুজো হয়।

পলাশির যুদ্ধ বা ব্রিটিশদের সঙ্গে রায়বাড়ি এবং তার সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে কখনোই যুক্ত ছিলেন না। নানান সমাজসেবামূলক কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ রাজা উপাধি ভাইসরয় কর্তৃক প্রদত্ত। রায়বাড়ির সদস্যরা তিন পুরুষ ধরে রাজা সম্মান পেয়েছেন। ১৯৩৮-এ কমলারঞ্জন রায় রাজা উপাধি পেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
দশঘড়ার বিশ্বাস পরিবারের দুর্গাপুজো

এই সকল তথ্য জানা গেল রাজবাড়ির বর্তমান সদস্য পল্লব রায় মহাশয়ের থেকে। পল্লববাবু জানান, কাশিমবাজার রাজবাড়িতে নবরাত্রি দুর্গাপুজোর রীতি। রথের দিন শ্রীপাট পুজো করে কাঠামোতে মাটি দেওয়া হয়। প্রথমে পাটপুজো, তারপর রথপুজো এবং রথটানা। তারপর মৃত্তিকার কাঠামোয় মাটি দেওয়া হয়। এক চালচিত্রের প্রতিমা। সিংহের রূপ হল 'গৌতম সিংহ' (সিংহ এবং ঘোড়ার মিশ্রণ)। অর্থাৎ শক্তি এবং স্ফূর্তির প্রতীক। প্রতিপদের দিন গঙ্গা থেকে ঘট ভরে এনে পুজো শুরু। ব্রাহ্মণরা দুর্গানাম এবং চণ্ডীপাঠ করেন। সপ্তমীতে আবার ঘট ভরে আনা হয়। রীতি অনুযায়ী প্রত্যেকদিন কুমারী পুজো হয়।

আরও পড়ুন
১৮৩ বছরে রামকৃষ্ণ-স্মৃতিধন্য কুমোরটুলির গঙ্গাপ্রসাদ ভবনের দুর্গাপুজো

কাশিমবাজারে প্রথা অনুসারে পুজোর তিনদিনই পাঁঠা বলির রেওয়াজ ছিল। এমনকী আগে সন্ধিপুজোতেও বলির রেওয়াজ ছিল। কিন্তু কমলারঞ্জন রায়ের আমল থেকে বলি বন্ধ। বর্তমানে শক্তির প্রতীক হিসেবে খড়্গ পুজো হয়। পুজোর তিনদিনই রাজবাড়িতে ভোগ খাওয়ানোর রেওয়াজ। প্রত্যেক সন্ধ্যারতির আগে এবং পরে থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান।

দশমীর সকালে মন্ত্রপাঠের পর দেবী যান বিসর্জনে। তারপর অপরাজিতা পুজো। অতীতে যুদ্ধে যাওয়ার আগে যুদ্ধে জয়ের প্রার্থনা করে পুজো হত। সেই থেকেই অপরাজিতা পুজোর রেওয়াজ। শুধুমাত্র কাশিমবাজার, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ নয়; কলকাতা থেকেও বহু মানুষ এই পুজো দেখতে যান। পল্লববাবু জানান, আগে হাতি, অস্ত্র নিয়ে শোভাযাত্রা হত। এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেলেও পুজোর জৌলুস এবং লোক সমাগম বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিহাস আর আভিজাত্যের মিশেলে এভাবেই সাবেকিয়ানা আর ঐতিহ্যকে প্রতিবছর নতুন রঙে রাঙায় কাশিমবাজার রাজবাড়ির দুর্গা।

চিত্রঋণ : Cossimbazar palace of the roys (facebook page)

Powered by Froala Editor