দশঘড়ার বিশ্বাস পরিবারের দুর্গাপুজো

কলকাতা থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট গ্রাম দশঘড়া। গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গের ধনেখালি বা ধনিয়াখালি ব্লকের গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে। শাড়িপ্রেমীদের কাছে ধনিয়াখালি নাম বিশেষ পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিখ্যাত শাড়ি ধনেখালি বা ধনিয়াখালি শাড়ি। সাতশো বছর আগে বারোদুয়ারি রাজাদের রাজধানী এই দশঘড়া। উজ্জয়িনী নগরের বণিকরা বাস করতেন এখানে।

দশঘড়ার পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে বয়ে যেত দামোদরের দুই উপনদী বিমলা, কানানদী। ধর্মমঙ্গলে উল্লেখ রয়েছে অধুনা বিলুপ্ত বিমলার। নদীপথ বর্তমান হুগলির হরিপালের উপর দিয়ে। সে-যুগে 'শিমুলা' নামে পরিচিত হরিপাল। যাই হোক, বণিকরা উপনদী দুটির তীরে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। উপনদীগুলি দশঘড়াকে করে তুলেছিল বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যদিও কালের নিয়মে দামোদর নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। বাক্স প্যাঁটরা গোছাতে থাকেন বণিকরা। ধাক্কা খায় ব্যবসা। শাসকরাও পরবর্তীতে চলে যান মেদিনীপুরে।

দশঘড়া; এমন নামকরণ কেন, তা নিয়ে নানান গল্প। বাংলায় 'দশ' অর্থাৎ ১০ সংখ্যা। 'ঘড়া' অর্থাৎ পাত্র। জনশ্রুতি, দশটি প্রতিবেশী গ্রাম— আগলাপুর, দীঘরা, গঙ্গেশনগর, গোপীনগর, ইছাপুর, ঝাড়গ্রাম, নলথোদা, পারম্বো, শ্রীকৃষ্ণপুর এবং দৃরামপুর একত্রিত হয়ে দশঘড়া নামকরণ হয়। তবে এ সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। আরেকটি জনশ্রুতিও রয়েছে। বাংলায় মুঘলদের আক্রমণের সময় সম্পদ রক্ষার জন্য সেই সময়ের ধনী রাজা ও জমিদাররা তাঁদের সমস্ত মূল্যবান ধনরাশি, স্বর্ণমুদ্রা ও গয়না দশটি পাত্রে জমা করে পাশের পুকুরে জমা রেখেছিলেন, যার নামও দশঘড়া।

এখানকার বিশ্বাস পরিবারের দুর্গাপুজো উল্লেখযোগ্য। পুজো উপলক্ষে বসে চাঁদের হাট। বিশাল প্রাসাদ দেখে মুগ্ধ হতেই হয়। পাশেই গোপীসাগর নামে এক বিশাল পুকুর। রাজপ্রাসাদটি পুকুরের জলে প্রতিফলিত হয়। পুকুরের নামকরণ বিখ্যাত পোড়ামাটির মন্দির গোপীনাথ মন্দিরের নামে। মন্দিরটি মূল প্রাসাদের ঠিক পিছনে।

আরও পড়ুন
১৮৩ বছরে রামকৃষ্ণ-স্মৃতিধন্য কুমোরটুলির গঙ্গাপ্রসাদ ভবনের দুর্গাপুজো

১৮ শতকে জগমোহন দেব বিশ্বাস দশঘড়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। রাজবাড়ির প্রতিনিধিত্ব করে এই বিশ্বাস পরিবার। জগমোহন খুবই প্রভাবশালী ধনী একজন জমিদার ছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই পরিবার প্রথমে হরিদ্বারে বসতি স্থাপন করলেও পরে তারা ‘বিশ্বাস’ উপাধি পেয়ে বাংলায় চলে আসে। যদিও অনেকেই বলেন তাঁরা ওড়িশার বাসিন্দা। পরবর্তীতে জগমোহন বিশ্বাসই দশঘড়ায় বসতি স্থাপন করে নিজেকে একজন প্রভাবশালী জমিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। জগমোহন বিশ্বাসের সময় থেকেই দশঘড়ার বর্তমান বিশ্বাস পরিবার এখানে থাকতে শুরু করে।

আরও পড়ুন
ঘরে ফিরলেন উমা, প্রবাসী মধুসূদনের চোখে ‘বারি-ধারা’

গোপীসাগর পেরিয়ে সিংহদ্বার দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চোখে পড়বে মন্দিরের প্রাঙ্গণে অপূর্ব সব স্মৃতিস্তম্ভ। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের ঘরানা এই স্মৃতিস্তম্ভগুলিতে প্রতিফলিত। প্রাঙ্গণ জুড়ে জলসাঘর, নহবতখানা, প্রধান কাছারি বাড়ি, জলেশ্বর শিব মন্দির এবং একটি অষ্টভুজাকার রাসমঞ্চ। মূল প্রাসাদের ঠিক পিছনেই অপূর্ব এক টেরাকোটার মন্দির এবং চারচালা দোলমঞ্চ।

আনন্দীরাম দেব বিশ্বাসের আমলে বিশ্বাস পরিবারে দুর্গাপুজো শুরু হয়। প্রধান কাছারি বাড়িটির ঠাকুরদালানে প্রতি বছর ঘটা করে পুজোর আসর বসে। পুজো কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যরা একাট্টা হন। দুর্গা এখানে চতুর্ভুজা। তাঁর চার হাতে তলোয়ার, ঢাল, ত্রিশূল এবং একটি সাপ। বাংলার অন্যান্য বনেদি বাড়ির মতো ঠাকুরদালানেই দুর্গা ও অন্যান্য দেব-দেবীর মূর্তি নির্মিত হয়। পুজোর সময় দর্শনার্থীরা বিনা দ্বিধায় বিশাল মন্দির প্রাঙ্গণটি দেখতে পারেন।

মন্দির প্রাঙ্গণটি পোড়ামাটির মন্দিরের জন্যও বিখ্যাত। এই মন্দির শ্রীসদানন্দ বিশ্বাস ১৭২৯ সালে নির্মাণ করেছিলেন। এটি পাঁচটি রত্নবিশিষ্ট পঞ্চশিখা মন্দির। পূজিত প্রধান দেবতা গোপীনাথ জিউ এবং রাধারানি। মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির সূক্ষ্ম কাজ দেখে মোহিত হয়ে যেতে হয়। রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন অলংকৃত ভাস্কর্য, পুরুষ, মহিলা, দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্য ইত্যাদি টেরাকোটার নকশায় রূপান্তরিত। রয়েছে শ্রীকৃষ্ণসহ অন্যান্য দেবতার ছবিও। ঘোড়াও রয়েছে লালমাটির পোড়া নকশায়। কখনো দেখা যায় ইউরোপীয় সেনাদল, যা ভিক্টোরিয়া ঘরানাকে ইঙ্গিত করে। মন্দির গাত্রের বেশিরভাগ অংশ বেশ কিছু পোড়ামাটির প্যানেল দিয়ে সজ্জিত।

কেভিন স্ট্যান্ডেজ, অ্যান ইন্ডিয়ান ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি ব্লগের একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, কলকাতার কুমারটুলির শিল্পীরা তারাপদ পালের তত্ত্বাবধানে মন্দিরের পুরনো পোড়ামাটির কাজের কিছু প্যানেল সংস্কার করেছেন। তাঁরা প্রায় ৫০টি ক্ষতিগ্রস্ত টাইলের সঠিক প্রতিলিপি তৈরি এবং প্রতিস্থাপন করেছিলেন। কৃষ্ণের মূর্তি কোষ্ঠীপাথরের। অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি রাধারানির মূর্তি। কেবল দুর্গাপুজো নয়, রথযাত্রা এবং দোলযাত্রাও এই মন্দির চত্বরে আড়ম্বর সহকারে পালিত হয়।

চিত্রঋণ : buoyant lifestyles

Powered by Froala Editor