বাংলাদেশের বরিশাল জেলার একাংশের বাসিন্দারা দশমীর দিন নিজেদের ঘরে পুঁটি মাছের আঁশ পুঁতে দেন। তাঁদের বিশ্বাস—যত অসংখ্য আঁশ, তত অসংখ্য ধনসম্পত্তির বিকাশ হবে। আবার যশোরের মানুষেরা দ্বীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোর দিন মাছের ঝোল, ভাত খেয়ে পান চিবোতে চিবোতে লক্ষ্মীর আঁড়ি পাতেন। বহু পূর্ববঙ্গীয় ব্রাহ্মণ পরিবারে কোজাগরীর সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর ভোগে জোড়া ইলিশ দেওয়ার রীতিটিও গুরুত্বপূর্ণ। চন্দ্রকেতুগড় সভ্যতায় পাওয়া একটি মূর্তির হাতে দেখা যাচ্ছে দুটো মাছ, ঠিক একই ভঙ্গিতে কায়স্থদের ঘরে ঘরে নববধূর প্রবেশ মুহূর্তে তার হাতে জলভরা কলসের সাথে জ্যান্ত জিওল মাছ ধরিয়ে দেওয়া হয়; পিছনে বরমশাই দর্পণ দিয়ে আঁড়ির ধান ফেলতে ফেলতে ঘরে প্রবেশ করে বিবাহের পরের দিন। মাছের সঙ্গে নদীনালাবেষ্টিত বাঙালির হৃদ্যতা নতুন কিছু নয়; নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মতো পুরাণ বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণে "...বার্তাকু সহিতায়ঃ সর্বেঃ মৎস্যা নিরামিষাঃ" কাহিনিও প্রায় সর্বজনবিদিত। আবার শাক্তোৎসবগুলিতে, বিশেষত তামসিক আচারের শাক্তোৎসবের সঙ্গে মৎস্যভোগের ব্যাপকতম সম্পর্কের কথাও আমরা কমবেশি সকলেই জানি। এছাড়াও ধনদেবী লক্ষ্মীর আরাধনার রীতিতেও জড়িয়ে গেছে মৎস্যকেন্দ্রিক আচার। বাঙলার বিবাহোৎসব তত্ত্বে মাছ পাঠানোর রীতি বহু প্রাচীন। সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটির বিবাহে তত্ত্বে কিছু না থাকলেও একটি মাছ এবং হলুদ থাকবেই। কেননা, মাছ কেবল ভোক্ষদ্রব্য নয়, শুভত্বের মঙ্গলচিহ্নও।
বাংলার লক্ষ্মী মূলত ধান্যলক্ষ্মী হিসেবেই পুজো পান। এর কারণ হিসেবে বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া এবং ধান্য উৎপাদন-কেন্দ্রিক জীবিকার ব্যাপকতম বিস্তারকেই আমরা ধরতে পারি। পূর্ববঙ্গীয় রীতির কোজাগরী উৎসবে যেমন কলার ভেলায় তৈরি ধানভর্তি নৌকা একটি অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী, তেমনই পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালির দীপান্বিতা লক্ষ্মীর পূজায় আসলে ধানভর্তি আঁড়ি বা ধানের গোলার ক্ষুদ্র প্রতীকটিকেই লক্ষ্মীদেবী হিসেবে পুজো করার রীতি আছে। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, নদী-নালা বেষ্টিত ওপার বাংলায় ধান বিপণনের প্রধানতম মাধ্যমই ছিল নৌকা; অতএব, সদা চঞ্চলা লক্ষ্মী সেই নৌকা মাধ্যমেই বিরাজ করেন—এমন ধারণা করা হয়। আবার এপারের লোকেদের সারা বছর ধান সঞ্চয়ে গোলার ভূমিকা ছিল অপরিসীম এবং এপারে তিনফসলি ধানের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বছরে তিনবার (ভাদ্র, পৌষ, চৈত্র) লক্ষ্মীর আরাধনার রীতিটি গভীর সাযুজ্য বহন করে।
এপার বাংলার দীপান্বিতা পুজোর গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী স্থলপদ্ম। বলা বাহুল্য, সুদূর অতীতে জলপদ্মের চাষের এত বিস্তার না থাকায়, লক্ষ্মীদেবীর প্রিয়তম ফুলটির বিকল্প হিসেবে এটি যুক্ত হয়েছে। এছাড়াও আটভাজা গুরুত্বপূর্ণ প্রসাদ। খড়িমাটি দিয়ে ধানের ছড়া এবং প্যাঁচার ছবি আল্পনা দেওয়া অবশ্যপালনীয় হিসেবে দেখা যায়। তবে, দীপান্বিতার দিন লক্ষ্মী একাই পূজিত হন না। কলার ডোঙার উপরে চালের পিটুলিতে লক্ষ্মী, নারায়ণ ও কুবেরের মূর্তি বানানো হয়। কলার ডোঙা সমেত এঁদের তিনজনকে রাখা হয় আঁড়ির সামনেই। সেখানেই তিন দেবতার পুজো হয়। অমাবস্যার পরদিন অর্থাৎ শুক্ল প্রতিপদে হয় কুবেরের বিয়ে। কোনো জলা বা তিন রাস্তার মাথায় পাটকাঠির মশাল জ্বালিয়ে আবালবণিতা ছড়া আওড়ায়—
পাটকাঠির আলো দে,
লক্ষ্মীর পো বিয়ে দে,
একগোলা ধান, একটা এঁড়ে বাছুর নিয়ে
এই আলো ভর করে আমাদের বাড়ি এসো...
আরও পড়ুন
লক্ষ্মী শুধুই চঞ্চলা নন, স্বয়ংসম্পূর্ণাও
পো অর্থাৎ সন্তান; লক্ষ্মীর পো হিসেবে কুবেরকে গ্রামঘরের মানুষ চিহ্নিত করেন। এঁড়ে বাছুরকেও সম্পদ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই।
আরও পড়ুন
কালীপুজোর দিনই আরাধনা করা হয় লক্ষ্মীর ‘দিদি’ অলক্ষ্মীকে; কিন্তু কেন?
প্রশ্ন জাগে, অলক্ষ্মী কি ধূমাবতী? আসলে মহালক্ষ্মী আর মহাকালী দুজনেই আদ্যাশক্তির ভিন্ন প্রকাশ। দীপান্বিতা পুজোর দিন সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কুলাচারে কালীঘাটের দক্ষিণাকালীকে লক্ষ্মী হিসেবেই পুজো করা হয়ে আসছে। সে দিক থেকে অমাবস্যা শক্তিপুজোর গুরুত্বপূর্ণ তিথি। এপার বাংলার মানুষ লক্ষ্মীকে শাক্ত দেবী হিসেবেই আরাধনা করেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গোবর পুত্তলিকার অলক্ষ্মী। কড়ি দিয়ে তৈরি হয় চোখ আর মেয়েদের ফেলে দেওয়া চুল দেওয়া হয় মাথায়, পুরোনো ছেঁড়া কাপড় তার বসন। অলক্ষ্মীকে লক্ষ্মীপুজো হওয়ার আগে ভাঙা কুলো বাজিয়ে বিদায় করে রেখে আসা হয় তিন মাথার যে-কোনো মোড়ে। ধূমাবতীর হাতেও দেখা যায় কুলো। এহেন ধূমাবতী, যিনি যাবতীয় জীর্ণ-রিক্ত-নিঃস্ব-র প্রতীক, তাঁকেই সম্ভবত অলক্ষ্মীর প্রকাশ হিসেবে সসম্মানে বিতাড়িত করেন গৃহস্থ। যে-কোনো শুভত্বের বিপ্রতীপে থাকা অশুভত্বকে দমন করাই চিরায়ত আচার হয়ে প্রতিভাত হয়; যে পুজোর প্রারম্ভে ভূতাপসরণ কিম্বা অলক্ষ্মী বিদায়, সবেতেই একই ছবি। পুরাণ বলছে, সমুদ্রমন্থনে লক্ষ্মীর আগমনের প্রারম্ভে অলক্ষ্মীর আগমন হয়েছিল এবং ঘটনাচক্রে তা দীপান্বিতার দিনই। তাই দীপান্বিতা উভয়েরই আবির্ভাব তিথি। সেজন্যই বোধহয় লৌকিক বিশ্বাসে লক্ষ্মী এবং মাছ উভয়েই গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কেননা, উভয়েরই পিত্রালয় সমুদ্র।
বাংলার নিজস্ব লক্ষ্মী আজ ক্রমাগত ম্রিয়মাণ হয়ে উঠছেন। ঘরে ঘরে গজলক্ষ্মীর ছবি কিংবা ধনলক্ষ্মী যন্ত্রের ব্যাপক প্রসারতার অন্তরালে আজ আর ধান্যলক্ষ্মী নিয়ে বাংলার এ প্রজন্মের আগ্রহ নেই। অথচ, একদা ধাননির্ভর অর্থনীতিই বাংলার প্রধানতম শ্বাস ছিল। ধান্যলক্ষ্মী-কেন্দ্রিক আচারগুলোও আজ হারিয়ে যাচ্ছে। পাটকাঠির আলোতে লক্ষ্মীর পো বিবাহের মতো আচার গ্রামাঞ্চলেও দ্রুত কমে আসছে। ক্ষয়ব্যাধির শ্রীহীন জীর্ণতা ছেড়ে আমাদের ধানের গোলা আবার ভরে উঠুক নতুন স্বপ্নের সন্ধানে…
Powered by Froala Editor