ডাকিনী-যোগিনী প্রসঙ্গে দু-চার কথা

পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি কালীপুজোর মণ্ডপে মূল প্রতিমার দু'পাশে প্রায়শই তাঁদের দেখা মেলে। অতি উগ্র, অতি বীভৎস দুই নারী- প্রায় নগ্নিকা, দুই হাতে মনুষ্যাকৃতি কোনও জীবের শরীর থেকে লোলুপ ভঙ্গীতে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছেন। ঘোরদর্শনা এই দুই শক্তি-সহচরীর নাম কমবেশি সবাই জানেন, ডাকিনী-যোগিনী। এঁরা কারা? পুঁথিপত্র ঘাঁটলে জানা যাবে ডাকিনী-যোগিনীর বিচিত্র ইতিহাস।

দেবী দক্ষিণাকালীর প্রচলিত পূজাপদ্ধতি পড়লে জানা যায়, মূল দেবতার পূজার পর পূজিত হন আবরণ দেবতার দল, অর্থাৎ যাঁরা মূল দেবতার (এক্ষেত্রে কালীর) সহচর, পার্শ্বচর বা পার্ষদ। ডাকিনীগণ ও যোগিনীগণও এই আবরণ দেবতা শ্রেণীটির অন্তর্ভুক্ত। কালীপূজার সময়ে এঁদের পঞ্চোপচারে পূজার বিধি রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে দুজন দেবতা নন, পূজিত হচ্ছেন দুটি শ্রেণী বা গোষ্ঠী- ডাকিনীগণ, যোগিনীগণ। এই দুটি গোষ্ঠীর প্রতিভূ হিসাবেই বারোয়ারি কালীপূজায় ওই দুই প্রতিমার স্থাপনা। 

প্রথমে যোগিনীদের কথা বলি। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় 'ইয়োগা' ডাকনামে এখন যে যোগের রমরমা, তা মূলত হঠযোগের একটি লঘু সংস্করণ- শরীর-মনকে তাজা, কর্মক্ষম রাখাই তার মূল উদ্দেশ্য। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে 'যোগ' বিষয়টি কখনওই এমন একমাত্রিক ছিল না। বেদ, উপনিষদেও যোগের উল্লেখ আছে। বেদভিত্তিক ষড়দর্শনের অন্যতম 'যোগদর্শন' গ্রন্থে পতঞ্জলি মুনি বলেছেন, যোগ কথার অর্থ "চিত্তবৃত্তিনিরোধ:" অর্থাৎ চিত্তের চঞ্চল প্রবণতাগুলিকে সংযত করা। মহাভারতের অন্তর্গত ভগবদগীতার আঠেরোটি অধ্যায়ের নামের সঙ্গেই 'যোগ' শব্দটি সংযুক্ত। গীতামুখে শ্রীভগবান কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, অষ্টাঙ্গযোগ, ভক্তিযোগ প্রভৃতি নানাবিধ যোগপথের মাহাত্ম্যখ্যাপন করে অর্জুনকে যোগী হবার উপদেশ দিয়েছেন। বৈষ্ণব চতু:সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যায় ভক্তিযোগই এই সমস্ত যোগপন্থার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। আবার শাক্ত, শৈব প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মেও ক্ষেত্রেও নিজস্ব যোগপদ্ধতির ধারণা আছে। অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি লাভের সাধনা মাত্রেই কোনও না কোনও মার্গের যোগসাধনা, একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। যাঁরা যোগ-অন্ত প্রাণ, তাঁরাই যোগী, স্ত্রীলিঙ্গে যোগিনী। 

আরও পড়ুন
পায়ের নিচে ‘দুজন’ শিব, শ্বেতবর্ণা কালীও, দেখা মেলে বাংলাতেই

শক্তি-উপাসনার মার্গে 'যোগ'-এর তাৎপর্য কী? 'শারদাতিলক' তন্ত্র জানাচ্ছেন, 

আরও পড়ুন
পাথুরিয়াঘাটার এই কালীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে বাঘাযতীন-সুভাষচন্দ্রও!

যোগশাস্ত্রের পণ্ডিতেরা বলেন, জীব ও আত্মার ঐক্যই যোগ। শিব ও আত্মার অভেদ দশাকে শিবোপাসকগণ যোগ বলেন। আগমবেত্তাদের মতে, শিবশক্ত্যাত্মক জ্ঞানই হলো যোগ। সাংখ্যমতে যিনি পুরুষ, ন্যায়মতে যিনি ঈশ্বর, বৈষ্ণবমতে যিনি নারায়ণ- তাঁর পরিচয়লাভই যোগ। কামাদি শত্রুগণকে জয় করার মাধ্যমে যোগপন্থায় যাত্রা শুরু হয়। (পটল ২৫, শ্লোক ১-৩) 

আরও পড়ুন
জার্মানির ডক-লিপজিগ তালিকায় কালীঘাটের যৌনপল্লি নিয়ে তৈরি সিনেমা

শাক্ত শাস্ত্রকার এইভাবেই যোগের বহুমাত্রিক তাৎপর্য নির্ণয় করেছেন । আর শক্তি-উপাসিকা সিদ্ধযোগিনীরাই দেবীর সহচরী। 

উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চৌষট্টি যোগিনীর প্রাচীন মন্দিরগুলি এখন পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট। এই সব দেবালয়ে মধ্যস্থলে থাকেন শিবশক্তি যুগল, তাঁদের ঘিরে চক্রাকারে অবস্থান করেন যোগিনীবৃন্দ। লোকবিশ্বাস অনুসারে, নিশুতি রাতে মন্দির যখন একেবারে নির্জন, তখন এই যোগিনীরা বায়ুপথে পাড়ি দেন আকাশমণ্ডলে, আবার ভোর হবার আগেই ফিরে আসেন। তাঁদের উড্ডয়নের পথ অবাধ রাখতেই এই মন্দিরগুলি হয় ছাদবিহীন। এই যোগিনীদের নাম নির্দিষ্ট নয়। এমনকী সংখ্যারও হেরফের হয়, বিয়াল্লিশ বা একাশি যোগিনীমণ্ডলের হদিশও পাওয়া গেছে। আর যাঁরা দুর্গাপুজোর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র একটু মন দিয়ে খেয়াল করেছেন তাঁরা জানেন, ভদ্রকালীরূপিণী দেবী দুর্গা কোটিযোগিনী-পরিবৃতা। অর্থাৎ শক্তির এই সহচরীরা এককথায় অসংখ্য। 

'ডাকিনী' শব্দের ব্যঞ্জনা বহুমাত্রিক। তন্ত্রমার্গে শরীরমধ্যস্থ মূলাধার চক্র, যেখানে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি সুপ্ত অবস্থায় থাকেন, সেই চক্রে অধিষ্ঠান করেন ডাকিনী শক্তি। আবার, মহাবিদ্যা ছিন্নমস্তার দুই পার্শ্বে থাকেন তাঁর দুই সহচরী ডাকিনী ও বর্ণিনী। ডাকিনীগণ শিব-শক্তির লীলাসহচরী বিশেষ একটি গোষ্ঠীও বটে। পুরাণে বিভিন্ন যুদ্ধের বিবরণে ডাকিনীগোষ্ঠীকে শিব ও শক্তির সেনাদলে দেখা গেছে। বাংলার মঙ্গলকাব্যেও দেখতে পাই তাঁদের। অন্নদামঙ্গলে দক্ষযজ্ঞনাশে শিবের সেনাদলে ডাকিনী যোগিনীদের দেখা মেলে, চণ্ডীমঙ্গলে কলিঙ্গরাজ এবং সিংহলরাজের বিরুদ্ধে চণ্ডী যখন যুদ্ধযাত্রা করেন, তখন অজস্র ভূত প্রেত পিশাচের সঙ্গে ডাকিনী-যোগিনীরাও তাঁর সঙ্গিনী হয়। 

রহস্যময় গুপ্তবিদ্যার অধিকারী প্রাজ্ঞ মানব-মানবীরাও এককালে 'ডাক' ও 'ডাকিনী' নামে পরিচিতি পেতেন। চর্যাপদের সঙ্গেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশ করেছিলেন 'ডাকের বচন'। বিশেষ করে বৌদ্ধ তান্ত্রিকসমাজে ডাকিনীরা ছিলেন সম্মাননীয়া, চুরাশি সিদ্ধর কাহিনীতে তাঁদের সিদ্ধসাধিকা ও গুরু, দুটি ভূমিকাতেই একাধিকবার দেখা গেছে। 

আবার এই গুপ্তবিদ্যার অপপ্রয়োগের ফলেই তাঁদের ঘিরে তৈরী হয়েছে জনতার ভয়, ক্ষোভ, রোষ। মধ্যযুগে তো বটেই, আধুনিক যুগেও ভারতের নানা প্রান্তে কত নারী যে ডাইনি সন্দেহে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা তো গুণে শেষ করা যাবে না। এঁদের মধ্যে অনেকে নির্মমভাবে নিহতও হয়েছেন। মধ্যযুগের সাহিত্যে ডাকিনীদের নিয়ে এই সামূহিক ভীতির নিদর্শন মিলবে। মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে দেখি, ধনপতির বাণিজ্যযাত্রার আগে তার কনিষ্ঠা পত্নী খুল্লনা স্বামীর মঙ্গলকামনায় চণ্ডীপূজা করছে। ঈর্ষাকাতর সপত্নী লহনা বণিকের কাছে গিয়ে নালিশ করল, "তোমার মোহিনী বালা/ শিক্ষা করে ডাইন কলা/ নিত্য পূজে ডাকিনী দেবতা।" লহনার শঙ্কাকাতর দৃষ্টির সামনে উপাস্য ও উপাসক দুজনেই ডাকিনী, আর ধনপতির চিন্তাও সেরকমই। তাই ক্রুদ্ধ ধনপতি খুল্লনার কেশাকর্ষণ করে ভর্ৎসনা করে, দেবীঘটে লাথি মারে। পরিণামে চণ্ডীর কোপে তার নিগ্রহের শেষ থাকে না। আবার চৈতন্যজীবনীতে দেখি, বালকপুত্র নিমাইয়ের উপরে যাতে ডাকিনী যোগিনীর কুনজর না পড়ে, সেজন্য গৃহদেবতা বিষ্ণুর কাছে প্রার্থনা করছেন জগন্নাথ মিশ্র (চৈতন্যভাগবত)। চৈতন্যচরিতামৃতকারের মতে, বিশ্বম্ভরের এই 'নিমাই' ডাকনামটির আড়ালে রয়েছে ডাকিনী আদি অপশক্তির ত্রাস। মাতৃস্থানীয়া প্রতিবেশিনীরা শিশুটিকে অপদেবতাদের কাছে অরুচিকর করে তোলার জন্য তার নাম রেখেছিলেন নিমাই (নিমের মতোন তেতো)। সুতরাং মধ্যযুগ জুড়ে জনতার মনে ডাকিনীদের নিয়ে যে কী তীব্র ভয় কাজ করত, তা তো দেখাই যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক যুগেও এই শঙ্কা খুব একটা কমেনি, তার নিদর্শন ধরা আছে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ডাইনী' গল্পে। কয়েকটি কাকতালীয় দুর্ঘটনার ফলে সমাজের চাপে পড়ে কীভাবে একটি নির্দোষ ও অসহায় মানবী 'ডাকিনী' কুখ্যাতি পেল, এ গল্প তারই আত্মদহন ও মর্মান্তিক মৃত্যুর আখ্যান। অবশ্য এখন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার ক্রমাগত চেষ্টায় ডাইনি সংক্রান্ত কুসংস্কার ও হিংসার ঘটনা অনেকটাই কমেছে। 

এই সামূহিক ত্রাস থেকেই দক্ষিণাকালীর দুই পাশে ডাকিনী যোগিনীর অমন ভয়াল মূর্তি। শাস্ত্রে ও ইতিহাসে যাঁদের রণরঙ্গিনী, সিদ্ধসাধিকা ও বিদ্যানিপুণা রূপের পুন:পুন: উল্লেখ, এই মূর্তিতে তাঁদের সেই উজ্জ্বলতার কোনও চিহ্নই কি ধরা পড়ে? জনগণ আজ তাঁদের কুৎসিত, নরমাংসলোলুপ, ভয়াল ভয়ঙ্কর ভাবতেই অভ্যস্ত। তবে এ কথা ঠিক, ডাকিনী যোগিনীর রূপকল্পনা যতই বীভৎস হোক, মানুষ এ কথা ভোলেনি যে তাঁরা শক্তিসহচরী, তাঁরা পূজনীয়া। তাই প্রলয়রূপিণী "মৃত্যুরূপা মাতা"-র দুই পার্শ্বে তাঁদের নিত্য অবস্থান।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More