স্ত্রীকে ইংরেজি শিক্ষায়তনে ভর্তি করিয়েছিলেন নারীশিক্ষার বিস্মৃতপ্রায় ‘নেতা’ মনমোহন ঘোষ

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়। ‘নবজাগরণ’-এর বাংলার পালে লেগেছে সামাজিক উত্থানপতনের ঢেউ। বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও নারীশিক্ষা ও নারীস্বাধীনতার জন্য চলছে এক বিরাট আয়োজন। আবার নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে ধ্বংসের মুখে গ্রামীণ বাংলার জনজীবন। ক্রমে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্বেষ হয়ে উঠবে কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনীতির মূল চর্চিত বিষয়। ঘটনাচক্রে ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষ (Monomohun Ghose) জড়িয়ে ছিলেন প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই। ইংরেজি আদবকায়দার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির জন্য ব্যঙ্গের শিকার হতে হয়েছে বারবার। তবু স্বদেশচেতনা ও নারীশিক্ষার জন্য আজীবন উন্মুক্ত ছিল তাঁর স্বর।

১৮৪৪ সালের ১৩ মার্চ পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে তাঁর জন্ম। পিতা রামলোচন ঘোষ ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। জড়িত ছিলেন সমাজসংস্কারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও। সেই আবহেই উদারতার দিগন্তবিস্তৃত মনোভাব নিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিলেন মনমোহন ঘোষ। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করার কিছুদিনের মধ্যেই জড়িয়ে পড়েন বিবাহবন্ধনে। জন্ম ও শিক্ষাসূত্রে গ্রামবাংলার লোকজীবনের সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিতি ছিল তাঁর। দেখেছিলেন নীলচাষিদের কষ্ট। নিজের হাতে তো উপায় বলতে একমাত্র ইংরেজি শিক্ষা। জ্বালাময়ী এক বক্তব্য লিখে পাঠিয়ে দেন ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায়। কিন্তু ১৮৬১-তে সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে অমুদ্রিত থাকে সেই লেখা। পরে যখন তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন, তখন বন্ধু কেশব সেনের সূত্রে লেখাটি প্রকাশিত হয় ‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এ। বলা যেতে পারে এখান থেকেই শুরু তাঁর স্বদেশপ্রেমের যাত্রা। 

কলকাতার পড়াশোনা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না। পরের বছরই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার জন্য পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ড। একা নন, তাঁর সঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। হিন্দুর ছেলের বিদেশ যাত্রা নিয়ে তোলপাড় হল কলকাতার রক্ষণশীল সমাজ। তার সঙ্গে লড়াই করা যতটা কঠিন, তার থেকেও কষ্টসাধ্য এক ভারতীয়ের পক্ষে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। পরাধীন জাতির পরীক্ষার্থীদের জন্য ঘনঘন বদলাত নিয়ম। মনমোহনকে সেখানে শিকার হতে হয় জাতিবিদ্বেষের। দুবার পরীক্ষা দিলেন তিনি, সাফল্য পেলেন না একবারও। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য প্রথম ভারতীয় হিসেবে লাভ করেন আইসিএস ডিগ্রি। 

হয়তো আরো কিছু বছর মনমোহন চেষ্টা করে যেতেন পাশ করার। ইংল্যান্ডের একটি সংস্থা থেকে ডাক আসে সেখানে ওকালতি প্র্যাক্টিস করার জন্য। কিন্তু ১৮৬৬ সালেই মৃত্যু ঘটে পিতা রামলোচন ঘোষের। ফলে প্রত্যাবর্তন এবং কলকাতা হাইকোর্টেই ব্যারিস্টারি শুরু। ইংরেজি ভাষার প্রতি ছিল তাঁর আশ্চর্য দখল। আবার আইনের বেড়াজালে বেঁধে ফেলতে পারতেন অপরাধীর সমস্ত যুক্তিকে। পক্ষপাতযুক্ত ব্রিটিশ আদালতি ব্যবস্থায় বহু নির্দোষ ভারতীয় ন্যায়বিচার পেয়েছিলেন শুধুমাত্র তাঁর কৃতিত্বে। ফলে খুব কম সময়ের মধ্যেই আইনজীবী হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন তিনি।

আরও পড়ুন
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাঙালি ‘শিক্ষক’গোষ্ঠী ও প্রথম বাংলা হাতের লেখার শিক্ষক

কিন্তু তাঁর মূল পরিচিতি ছিল নারীশিক্ষা ও নারীস্বাধীনতার প্রসঙ্গে। ইংল্যান্ড থেকে ফিরেই নিজের স্ত্রীকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে ভর্তি করিয়ে দেন লোরেটো কনভেন্টে। এমনকি স্ত্রী স্বর্ণলতা শাড়ি পরা ছেড়ে শুরু করেন গাউন পরার অভ্যাস। যা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি সে সময়ে। কিন্তু মনমোহন নাছোড়বান্দা। দেশীয় সংস্কারের বহু বিধি ছুঁড়ে ফেলে মুক্ত চিত্তে গ্রহণ করলেন পাশ্চাত্য রীতিকে। কিছু ক্ষেত্রে যা হয়তো সাক্ষী দেবে উগ্রতার। কিন্তু স্ত্রীকে বিদেশি শিক্ষায়তনে ভর্তি এক আশ্চর্য উদাহরণ তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। ১৮৭২ সালে স্ত্রীক্ষা বিস্তারের জন্য কলকাতায় এসে পৌঁছোন অ্যানেট অ্যাক্রয়েড। হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে তাঁর নাম। মনমোহন সর্বান্তকরণে সাহায্য করলেন তাঁকে। উনিশ শতকের শেষ কয়েক দশকে একাধিক স্কুল স্থাপনায় প্রত্যক্ষভাবে ছিল তাঁর উপস্থিতি। আমৃত্যু বহন করেছেন বেথুন কলেজের সম্পাদকের দায়িত্ব।

আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও বাঙালির তৈরি প্রথম থিয়েটারের গল্প

ভারতের রাজনীতিতেও তখন আসছে বাঁকবদল। ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারত সভার প্রথম পর্বের আলোচনাসভা বসত তাঁর বাড়িতেই। পরে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর যুক্ত হন তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও। প্রশাসন ও আইনি বিচার ব্যবস্থার ধারা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া উচিত, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন জাতীয় নেতাদের। নিজেও দেশের বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি ইংল্যান্ডে পর্যন্ত যান এ বিষয়ে কথা বলতে। তাঁর ভাই লালমোহন ঘোষও ছিলেন ব্যারিস্টার এবং ১৯০৩ সালে কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৮৯৬ সালের ১৬ অক্টোবর, পুজোর ছুটিতে কৃষ্ণনগরের গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন প্রয়াত হন মনমোহন ঘোষ। এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অসংখ্য বৈপরীত্য ছিল তাঁর কর্মকাণ্ডে। স্বদেশপ্রেমের জন্য জড়িয়ে ছিলেন রাজনীতিতে, বাংলার লোকেদের জন্য লড়াই করতেন ব্যারিস্টারের পোশাকে। আবার, প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন দেশীয় সংস্কার। ইংরেজ রীতিনীতির প্রতি ছিল একপ্রকার অন্ধ আনুগত্য। আসলে উনিশ শতকের বাংলার জীবনচেতনার মধ্যে কাজ করেছে এই ‘দ্বিধা’। মনমোহন ঘোষও তাঁর বাইরে নন। বরং এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে শিবনাথ শাস্ত্রীর একটি উক্তি,

“ঐ কালে নারীগণের উচ্চশিক্ষা বিধানার্থে যে কিছু আয়োজন হইয়াছিল, তিনি সে সকলের পৃষ্ঠপোষক ও উৎসাহদাতা ছিলেন। এজন্য তাঁহাকে নব্যবঙ্গের এই তৃতীয় যুগের একজন নেতা বলিয়া গণনা করা যাইতে পারে।”

Powered by Froala Editor