সময় তখন এত দ্রুত ছিল না। ঘড়ির কাঁটায় লেগে থাকত আলস্য। বিশ্বায়নের ঢেউ গ্রাম-মফস্বলে সজোরে আছড়ে পড়তে বাকি রয়েছে কয়েকটা বছর। মোবাইল-ইন্টারনেট শব্দগুলির সঙ্গে পরিচয় হয়নি আম-জনতার। বিনোদন বলতে তো একমাত্র পেটমোটা রঙিন বোকাবাক্স। ছাদে উঠে অ্যান্টেনা ঠিক করার সংস্কৃতি একটু একটু করে ভেসে যাচ্ছে পড়ন্ত শীতের সন্ধ্যায়। ছটা বাজলেই জ্বলে উঠত কাঠের ল্যাম্পপোস্ট। হলদে আলোয় বাড়ি ফেরার গতি বাড়ত ছায়াদের। মাথার মধ্যে খালি ঘুরত অবিশ্বাস্য কিছু মুহূর্ত। ওই শটটা যদি ওইভাবে মারা যেত, তাহলে ম্যাচ জেতা ছিল অবধারিত। কাল থেকে অমুককে আর বল করতে দেওয়া যাবে না। অফস্প্রিনটা ওর ঠিক আসে না। রাত বাড়ে, ঘুম আসে। আরো তীব্র হতে থাকে পরদিনের কল্পনা আর পরিকল্পনা। ‘দাদা’র মতো এগিয়ে এসে একটা ছয়, ঠিক যেন উড়ে গিয়ে পড়বে আড়চোখে দেখা একটা সাইকেলের বাস্কেটে।
স্বপ্ন পূরণ হয়নি। হওয়া সম্ভবও ছিল না। তা নিয়ে বিরাট কোনো আফসোস নেই কারোর মনে। শুধু সেই শেষ বসন্তের দিনে কীভাবে যেন একটা সংক্রামক বেদনা ছড়িয়ে পড়েছিল ছোটো-বড়ো সবার মধ্যে। আজও মনে আছে দিনটা। ২৩ মার্চ, ২০০৩। উত্তেজনার পারদ চড়ত দিনগুলিতে। বাজার-হাটে, দোকানে, অলি-গলিতে একটাই আলোচনা। একটাই স্বপ্ন। ভারতের হাতে ক্রিকেট বিশ্বকাপ ট্রফি (Cricket World Cup)। ২০ বছরের অপেক্ষার অবসান হবে এবার। দক্ষিণ আফ্রিকায় সৌরভ গাঙ্গুলি (Sourav Ganguly) আর কোচ জন রাইটের মাথায় নয়, বিশ্বজয়ের ছক তৈরি হচ্ছে পাড়ায়-পাড়ায়। ঠিক কীভাবে বল করলে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া যাবে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংকে, কিংবা শচীন-দ্রাবিড়দের ব্যাট কীভাবে আরো শানিত হয়ে উঠতে পারে।
একটা কাঁটা খচখচ করছিল বেশ কয়েকদিন ধরেই। গ্রুপ পর্বে আগে ব্যাট করে এই অস্ট্রেলিয়ার (Australia) কাছেই মাত্র ১২৫ রানে গুটিয়ে গেছিল ভারত। তাহলে কি টসে জিতলে এবার ফিল্ডিং নেওয়া উচিত? পিচ কী বলছে? আবহাওয়া? দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের বাউন্সি পিচের মাটির পর্যবেক্ষণ চলছে ভারতের মাঠে-ঘাটে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী ঘাটতি নেই বিন্দুমাত্র। বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানশিকারি শচীন তেন্ডুলকার আছে, সেমিফাইনালে কেনিয়ার বিরুদ্ধে সৌরভের শতরানের ইনিংস আছে। শুরুতে নেমে একাই ছারখার করে দেবে বীরেন্দ্র শেওয়াগ। এই তো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চোট নিয়েও আশিস নেহরা তুলে নিয়েছে ছটি উইকেট। কুম্বলে-হরভজনের জাদুতে মোহিত পুরো ক্রিকেট দুনিয়া। কে ভুলতে পারে বিষাক্ত স্যুইংয়ে ব্যাটারের প্যাডে বল আছড়ে পড়ার আগে জাহির খানের সেই ছোট্ট জাম্পটা? মাঝের দিকে ভরসা জোগাবে যুবরাজ সিং, মহম্মদ কাইফের ব্যাট। কিছু না হলে ক্ষীপ্র গতিতে ফিল্ডিংয়ে আটকে দেবে কম করে কুড়িটা রান।
ব্যক্তিগত প্রতিভায় ভরা দল নয়, ‘টিম ইন্ডিয়া’ নামবে মাঠে। আকাশে রংয়ের জার্সির মাঝে ত্রিবর্ণ দাগ। শহর থেকে দূরের অঞ্চলগুলিতে তখন সম্ভব ছিল না এরকম একটা জার্সি হাতে পাওয়া। তাতে কী? বিখ্যাত ‘টিম হাডল’ দেখে ভিতরটা তো রঙিন হয়ে গেছে ততদিনে। তিন দিক ঘিরে বসা একটা টিভি গল্প বলবে রূপকথার। প্রতিটি বল, প্রতিটি মুহূর্ত ভাগ হয়ে যাবে সামনের দর্শকদের মধ্যে। একটু বড়োরা ঝালিয়ে নিচ্ছে কপিল দেবের গল্প। মাঝের সারি শোনাচ্ছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কাহিনি। কীভাবে ঘরে-বাইরে ভেঙে পড়া একটা দলকে একত্রিত করে তুলল আমাদের ‘দাদা’। সত্যিই তো, এত নতুন প্রতিভা কবে একাত্ম হতে শিখেছে সবার সঙ্গে? দ্রাবিড়কে উইকেটকিপার হিসেবে তৈরি করা, জাভাগল শ্রীনাথকে ইংল্যান্ড সফরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা—গল্প যে কখন ‘মিথ’-এ পরিণত হয়ে যায় বোঝা মুশকিল।
আরও পড়ুন
ক্রিকেট বিশ্বকাপে ‘নবরস’, কী অর্থ বোঝায় চিহ্নগুলি?
কিন্তু রূপকথার জন্ম হল না। এবারও পর্যদুস্ত হতে হল অস্ট্রেলিয়ার কাছে। প্রথমে ব্যাট করে ৩৫৯ রানের পাহাড়প্রমাণ বোঝা চাপিয়ে দেয় তারা। রিকি পন্টিং একাই করলেন ১৪০ রান। ড্যামিয়েন মার্টিনও অপরাজিত রইলেন ৮৮ রানে। জেতার আশা তখন ছেড়ে দিয়েছে অনেকেই। আজকের দিনে হয়তো তাড়া করা যায় এই রান, কিন্তু তখনকার দিনে ছিল প্রায় অসম্ভব। তবু... তবু একটা মরিয়া চেষ্টা তো হবেই। হারার আগে হার মানা যাবে না কোনোভাবেই। ব্যাট করতে নেমে প্রথম বলেই চার মারলেন শচীন। বাজি ফেটে উঠল কোথাও একটা। আর তারপরেই বেজে উঠল বিদায়ের ঘণ্টা। গুঞ্জন শুরু হল ফের, বড়ো ম্যাচে খেলতে পারেন না শচীন। একমাত্র চেষ্টা করলেন বীরেন্দ্র শেওয়াগ। তাঁর ৮২ রানের ইনিংসে ক্ষণকালের সঙ্গী হয়ে এলেন কখনও রাহুল দ্রাবিড় তো, কখনও যুবরাজ সিং। অবশেষে ২৩৪ রানে শেষ হল ভারতের ইনিংস। শেষ হল ভারতবাসীর স্বপ্ন।
আরও পড়ুন
পুরুষ নয়, প্রথম চালু হয়েছিল মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ
অনেকেই বলত, এই অস্ট্রেলিয়াকে হারানো যায় না। এতটাই শক্তিশালী তাঁদের টিম। ওসব কথা মন মানতে চায় না। আসলে তো রিকি পন্টিংয়ের ব্যাটে লোহার পাত লাগানো ছিল! নাহলে আমাদের বোলারদের সঙ্গে কখনই পেরে উঠত না ওরা। আর তাছাড়া সৌরভই বা কী সিদ্ধান্ত নিল ওটা? টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়া উচিত হয়নি একেবারেই। গ্রুপ পর্বে যাই হয়ে যাক না কেন, ফাইনাল তো অন্য ম্যাচ। কত বিতর্ক, কত রাগ, কত ঝামেলা শুধুমাত্র একটা হারকে ভোলার জন্য। তবে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট ছিল। জিতব, এই বিশ্বাসটা দানা বেঁধেছিল সবার মনে। ওই বিজ্ঞাপনটার মতো, যেখানে সিংহের গর্জনের সামনে থেকে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে আসে ‘টিম ইন্ডিয়া’। আক্ষরিক অর্থেই তো দক্ষিণ আফ্রিকার পিচে সিংহের সঙ্গে লড়াই। প্রতিটা ধাপ পার করেছিল ভারত, শুধু অপূর্ণ থেকে গেল শেষ পাতাটা।
সত্যিই কি তাই? ২৩ মার্চ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল ভারত। অন্তত ক্রিকেটের দিক থেকে। অজান্তেই কখন শূন্য হাত ঘুরে ওঠে হরভজনের মতো। রীতিমতো অনুশীলন চলে শচীনের মতো স্ট্রেট ড্রাইভের। এর আটবছর পরে, ২০১১-তে যখন মহেন্দ্র সিং ধোনির অধিনায়কত্বে বিশ্বকাপ জেতে ভারত, তখন সময়টার অনেক বদল এসেছে। বদলেছে স্বপ্ন দেখার মাপকাঠি। যে কাঁটাটুকু যত্ন করে রাখা ছিল সঙ্গোপনে, তার বেশিরভাগটাই উপড়ে গেল শচীনের হাতে ট্রফি দেখে। শুধু একটুখানি রয়ে গেল। না, কোনো বিশেষ কারণে নয়। নিছক স্মৃতি হিসেবেই। ওটুকু থাকা বোধহয় ভালো।
আবার একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল। ফের মুখোমুখি ভারত-অস্ট্রেলিয়া। আবার বছর কুড়ি পরে দেখা। এখনও পর্যন্ত অপরাজিত ভারত, রীতিমতো হেলাফেলা করেছে বাকি দলগুলিকে নিয়ে। তবু ফাইনালের অস্ট্রেলিয়া মানে তো একটু বুক দুরুদুরু থেকেই যায়। প্রতিশোধ, বদলা-র মতো শব্দ ঘুরছে সমাজমাধ্যমে। সেসব বরং থাক। শুধু কুড়ি বছর পুরনো খাতার শেষ পাতাটা পূর্ণ হোক, এটুকুই শুধু চাওয়ার। রোহিত শর্মাদের ‘টিম ইন্ডিয়া’ পারবে সেই স্বপ্নপূরণ করতে। এই বিশ্বাস নিয়েই ফিরে যাওয়া টিভির পর্দার সামনে।
Powered by Froala Editor