লন্ডনের বিখ্যাত ওয়েম্বলি পার্কে তখন চলছে ব্রিটিশ রাজত্বের বিশেষ প্রদর্শনী। দেশবিদেশের শিল্পীদের পাশে মাটির পুতুলের ডালি নিয়ে বসে বাংলার মৃৎশিল্পী জি. পাল। তাল তাল মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে তুলছেন আত্মমগ্ন এই শিল্পী। সেই সময় প্রদর্শনী দেখতে এসেছেন মহারানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র ডিউক অফ কনট’। ভারতীয় শিল্পীর মণ্ডপের কাছে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। যেন কোনো এক জাদুবলে নরম মাটি আঙুলের স্পর্শে হয়ে গেল আরেক কনট। মুহূর্তের মধ্যে ভিড় জমে গেল সেখানে। পরের দিন লন্ডনের সংবাদপত্রে তাঁর নাম ছাপা হতেই বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেল কৃষ্ণনগরের গল্প, সঙ্গে কুমোরটুলিরও।
শিল্পীর পুরো নাম গোপেশ্বর পাল। ১৯১৫ সালে লর্ড কারমাইকেল কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে এসে তাঁর হাতের কাজ দেখে উপাধি দেন, ‘দ্য লাইটনিং স্কাল্পচার’। তারপর ইংল্যান্ড যাত্রা এবং ফিরে এসে কুমোরটুলিতে স্টুডিও। সেটা ১৯২৪-এর কথা। কিন্তু কুমোরটুলির ইতিহাস খুঁজতে হলে যেতে হবে আরো পিছনে। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে আদেশ দেওয়া হয় একই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষরা থাকবেন একটি নির্দিষ্ট স্থানে। সেই অনুযায়ী গড়ে ওঠে কলুটোলা, আহিরীটোলা, ছুতোরপাড়া এবং অবশ্যই কুমোরটুলি। ব্রিটিশদের নথিতে সেই থেকে শুরু। সে বছরই রাজা নবকৃষ্ণ দেব কলকাতায় শুরু করেন দুর্গাপুজো। অবশ্য তারও আগে থেকেই কলকাতার আদি কুম্ভকার সম্প্রদায়রা এখানে মূলত তৈরি করতেন মাটির বাসনপত্র। অনুমান করা হয় যে, এদের অধিকাংশরই নিবাস ছিল হুগলির সপ্তগ্রামে। সরস্বতী নদী মজতে শুরু করলে তারা এসে ওঠে গঙ্গা সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে। বিশ শতকের গোড়াতেও কিন্তু চল ছিল মাটির বাসন বানানোর। কলকাতায় দুর্গাপুজোর প্রচলনের পরেই নদিয়া থেকে আসতে শুরু করেন মৃৎশিল্পীরা। শুরু হয় দেবীমূর্তি তৈরির কাজ।
ক্লাইভের আমল থেকে দুর্গাপুজোর শুরু হলেও প্রতিপত্তি দেখানো চালু হয় ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে। মধুসূদন পাল, কাঙালিচরণ পাল প্রমুখ ছিলেন প্রথম যুগের শিল্পী। তারপর দেবীর আদলে, ছাঁচে, পোশাকে, চালায় এসেছে বহু পরিবর্তন। সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিও জড়িয়ে তার সঙ্গে। প্রথম যুগের একচালা বাড়ির ঠাকুরের সনাতন রূপ ছিল হলুদ রঙের প্রতিমা, আমপাতার রংয়ের অসুর আর সাদা, ইলিশের মতো মুখের সিংহ। যার মুখে থাকত পাকানো গোঁফ, আলতো করে কামড়ে আছে অসুরের হাত। দেব কিংবা লাহা বাড়ির পুজোর সিংহ এরকমই। আঠারো শতকের শেষের দিকে ভিক্টোরিয়া ভারতের ‘রানি’ হওয়ার পর ওয়েলেসলি রাজভবনের তোরণে বসান কেশর দোলানো সিংহের মূর্তি। যেন টিপু সুলতানের বাঘের বিরুদ্ধে ইংরেজ শাসকের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ। চওড়া কাঁধ, পেশীবহুল শরীর, আকাশে ওঠানো মাথা—ক্রমে এই রূপটিকেই দেখা যেতে লাগল দুর্গার বাহনেও। বাঙালি শিল্পীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না সত্যিকারের সিংহ দেখা। সাদা সিংহের অবাস্তব আখ্যানকে সরিয়ে নতুন ‘বাস্তব’ সিংহের আগমন, সেটা একটা কারণ হতেই পারে। নাকি পরাজিত জাতির অসহায়তার প্রকাশ?
কুমোরটুলিতে ছিল আঁকার কাজের রমরমা। মাটির শাড়িতে আঁকা হত বহু ধরনের নকশা। আর ছিল চালচিত্রের কাজ। পুরনো বাঙালি আদলে প্রতিমা গড়তেন জিনু পাল, কাঙালি পাল, অন্নদা পাল প্রমুখ। চালের নামেরও ছিল বাহার—রামচন্দ্রী, দশাবতরী, ইন্দ্রাণী, ব্রহ্মাণী, কৈলাসী। তারপর বিশ শতক আসতে উঠে গেল একচালার কাজ। গোপেশ্বর পাল ছিলেন এই বিষয়ে পথিকৃৎ শিল্পী। ততদিনে কলকাতায় শুরু হয়ে গেছে সার্বজনীন পুজো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, আর্থিক মন্দা ও শিল্পায়নের জেরে টুকরো হতে শুরু করেছে যৌথপরিবার। শুধু শৈল্পিক দাবি, এই প্রেক্ষাপটটিও যেন জড়িয়ে যায় একচালার মূর্তির বহু খণ্ডে ছড়িয়ে পড়ার পিছনে। এছাড়া সুভাষচন্দ্র বসুর সেই ঐতিহাসিক দুর্গাপুজোর কাহিনি তো রয়েছেই। গোপেশ্বর পালই মাতৃমূর্তির হলুদ রংয়ে মেশালেন গোলাপি আর পরে রমেশ পাল মেশান কমলা রং।
আরও পড়ুন
জলঘড়ির সময় মেনেই চলে পুজো, ৪০০ পেরিয়েও অক্ষুণ্ণ হরিপাল রায়বাড়ির রীতিনীতি
তারপর এল চারের দশক। দুর্ভিক্ষ, স্বাধীনতা আন্দোলন, দাঙ্গা, দেশভাগ আর স্বাধীনতার ঘটনায় জেরবার বাঙালি জীবন। সেই হিংস্রতাই যেন এসে পড়ল অসুরের মুখে। তিনের দশকের একচালার ঠাকুরে কিন্তু অসুরের মুখ হাঁ থাকত না। ক্রমে দাঁত-নখ বেরিয়ে পড়ল তার। জোরালো হল সিংহের কামড়। দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে ফিনকি দিয়ে উঠল রক্তের ঝলক। দেশভাগের পর পদ্মাপার থেকে বহু শিল্পী চলে এল কুমোরটুলি। রুচি-ভাষাগত তফাতের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চেতনার পার্থক্যে একপ্রকার দ্বন্দ্ব শুরু হল সেখানে। ১৯৪৭-এ ফরিদপুর থেকে আসেন ধনঞ্জয় রুদ্রপাল। পরের বছর ঢাকা-বিক্রমপুরের রাখাল পালের সঙ্গে আসেন তাঁর চার ভাই হরিবল্লভ, গোবিন্দ, নেপাল ও মোহনবাঁশি। কুমোরটুলিতে তখনও বিষ্ণুপুরী ও কংসনারায়ণী চালার প্রচলন ছিল। পূর্ববঙ্গের শিল্পীরা কিন্তু আগে থেকেই বহুচালার মূর্তিতে অভ্যস্ত ছিলেন, ফলে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় তাঁদের কাজ।
আরও পড়ুন
পুজো মানেই পুজোসংখ্যা, কেমন ছিল প্রথম পুজো সংখ্যার বিজ্ঞাপন?
সাতের দশকে গোরাচাঁদ পালের চেতনায় ধরা দিল গ্রামবাংলার মাতৃমূর্তি। রাখাল পাল, অনিল পাল, নেপাল পাল প্রমুখ ভাস্বর হয়ে উঠলেন আপন প্রতিভায়। সেই ঐতিহ্যকেই এগিয়ে নিয়ে যান সনাতন রুদ্রপাল, অলক সেনের মতো শিল্পীরা।
সেই ট্র্যাডিশন চলেছে এখনও। সারা বছরই লেগে থাকে ভিড়। বিশেষ করে শারদোৎসবের ঠিক আগে আগ্রহী দর্শকের চোখ উপেক্ষা করেই চলে অক্লান্ত পরিশ্রম। কয়েকশো বছরের ইতিহাস তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। পরিবর্তনের বহু গলি ঘুরে এসে এক রয়ে গেছে সেই চক্ষুদানের বিদ্যা। শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, কাশফুল আর প্রতিবছর কুমোরটুলির ভিড় বাড়তেই বোঝা যায়, ‘তিনি আসছেন’।
তথ্যঋণ :
কলকাতার প্রতিমাশিল্পীরা, অনিতা অগ্নিহোত্রী
কুমোরটুলির চারশো বছরের বিবর্তন, জয়ন্ত দাস, দেশ, ১৯৯৮
কলকাতার স্থাননাম, সুবীর ভট্টাচার্য
Powered by Froala Editor