নবাবের শহর লক্ষ্ণৌ। ঐতিহাসিক স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। ইংরেজরা বলত ‘সিটি অফ গার্ডেনস’। আওধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহকে কলকাতায় নির্বাসনের অর্ধশতাব্দী কাটেনি তখনও। শাসক ইংরেজের সংস্কৃতি গলার ফাঁসের মতো বসেনি শহরটার বুকে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় গানের আসরে থাকতেন বরকৎ আলি খান, আহম্মদ খলিফ খাঁ, আবদুল করিমের মতো শ্রেষ্ঠ ওস্তাদরা। বাড়ির মালিকের নাম এ. পি. সেন। পেশায় উকিল এই মানুষটিকে লক্ষ্ণৌয়ের বাঙালিরা তো বটেই, একডাকে চেনে বহু মানুষ। অবশ্য সঙ্গীতের আসরে একবার ঢুকে পড়লে দিব্যি ভুলে যেতেন আদালত-মক্কেলের হাজারো সমস্যা।
তাঁকে আপামর বাঙালি চেনে অতুলপ্রসাদ সেন (Atul Prasad Sen) নামে। লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর ১৯০২ সাল থেকে আমৃত্যু লক্ষ্ণৌতেই বসবাস করেছেন তিনি। ছিলেন ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’-এর অন্যতম উদ্যোক্তা এবং ‘উত্তরা’ পত্রিকার সম্পাদক। সমাজসেবার বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকার ফলে অহরহ লেগে থাকত মানুষের ভিড়। তাছাড়া মক্কেলদের আনাগোনা তো আছেই। এরকমই একদিন, সকাল ন’টা নাগাদ মক্কেলদের বিদায় দিয়ে তোড়জোড় করছেন কোর্টে যাওয়ার। হঠাৎ উপস্থিত এক মৌলবি সাহেব। তিনি দেখা করবেন না কিছুতেই, এদিকে মৌলবিও নাছোড়বান্দা। অবশেষে অতুলপ্রসাদ রাজি হতে ঘরে ঢুকলেন মুসলমান ভদ্রলোক। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, গায়ে চাপকান। খানিক বিরক্তি নিয়েই জানতে চাইলেন তাঁর আসার কারণ। মৌলবি সাহেব উত্তর দিলেন পরিষ্কার বাংলা ভাষায়, “কী অতুলবাবু, চিনতে পারছেন?” বলেই মাথার ফেজ টুপিটি খুলে হাসতে লাগলেন ভদ্রলোক। দেখা গেল, তিনি আর কেউ নন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়!
তাঁর উপদেশে কাশীর ‘প্রবাসজ্যোতি’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশ চক্রবর্তী আসেন অতুলপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করতে। সেটা ১৯২০ সাল। সুদূর প্রবাসে এক বাঙালি যুবক ভাষার উন্নতির জন্য তাঁর কাছে ছুটে এসেছেন জেনে অত্যন্ত আগ্রহী বোধ করলেন তিনি। যেচে গ্রাহক হলেন পত্রিকার। কিন্তু নিজে লেখা দিতে ইতস্তত করলেন। লেখালেখি প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। সম্বল বলতে আছে কয়েকটি পুরনো খাতা। অক্ষরের উজ্জ্বল কালি মলিন হয়ে এসেছে তখন। সম্ভবত বাংলার কোনো পত্রিকা থেকে ডাক আসে না আর। সুরেশবাবু বেছে নিলেন দুটি গান, ‘মোদের গরব, মোদের আশা’ এবং ‘হরি হে, তুমি আমার সকল হবে কবে...’। অতুলপ্রসাদের সলজ্জ চোখে ধরা পড়ল প্রশংসা। যেন দীর্ঘদিন ধরে বন্দি কোনো অপূর্ণ আশা মুক্তির স্বাদ পেল প্রথমবার।
১৯২৫ সালে প্রথম গ্রন্থিত হয় তাঁর গানের সংকলন ‘কয়েকটি গান’। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল সেই কাজে। ১৯৩০-এ সাহানা দেবীর সম্পাদনায় দুই খণ্ডে ‘কাকলি’ এবং ১৯৩১-এ ‘গীতিগুঞ্জ’-তে ধরা রয়েছে তাঁর ২০৮টি গান। বাংলায় গজলও লিখেছেন বেশ কয়েকটি। যাঁর গানে সরল-প্রাণবন্ত এক মানুষের সুখ-দুঃখের ঘরকন্না ব্যক্ত হয়ে ওঠে, তিনি নিজে গান সংকলনের ব্যাপারে ছিলেন একেবারেই অপটু। অথচ রাজনীতির মঞ্চে তাঁর কণ্ঠ থেকেই বেরোতো অগ্নিসম হুঙ্কার।
আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের নাচ, ঢিলে কাঁচুলিতে ষোড়শী, বললেন ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ
১৯১৬-১৭ পর্যন্ত তিনি ছিলেন লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সেও ওকালতি ফেলে ছুটে বেড়াতেন রিসেপশন কমিটির কাজে। পরে কংগ্রেসের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেলে তিনি চলে এলেন লিবারাল লিগের দিকে। তাঁর বাড়ির সামনের বাগানে সূত্রপাত হল সেই আন্দোলনের। পরে সভাপতিত্ব করেন বেনারস প্রাদেশিক লিগের। তখন গান্ধীজির নেতৃত্বে শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন। মুখে অহিংসা ও শান্তির বাণী প্রচার করলেও কংগ্রেসের অহেতুক উত্তেজনা অপছন্দ ছিল তাঁর। যদিও গান্ধীজির হরিজন উন্নতির প্রতি অত্যন্ত সহমর্মী ছিলেন তিনি। অন্যদিকে কংগ্রেসের দাপটে ক্রমাগত কমতে থাকে লিবারাল পার্টির জনপ্রিয়তা। ১৯৩৩-এ সংযুক্ত প্রদেশের (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ) এলাহাবাদে লিবারাল পার্টির সম্মেলনে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’-এর প্রেক্ষিতে ইংরেজিতে বক্তৃতা রাখেন তিনি। যার বাংলা অনুবাদ হতে পারে এরকম, “আমরা আজও আমাদের ভাগ্যের নির্মাতা হয়ে উঠতে পারছি না। অন্য জাতির অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হচ্ছে। এই অবস্থা যে কোনো আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ভারতবাসীর কাছে চরম লজ্জার।”
আরও পড়ুন
গান শিখেছেন অতুলপ্রসাদের কাছে, বাসি খাবার খেতে যেতেন উত্তমকুমারের বাড়িতে
এ যেন ‘উঠ গো, ভারতলক্ষ্মী’-র অনুরণন। দুঃখ লাঞ্ছনায় জর্জরিত ত্রিশ কোটির দেশকে আহ্বান জানিয়েছিলেন ‘শোক শয্যা’ থেকে উঠে আসার। স্বল্পবাক, গুরুগম্ভীর প্রকৃতির মানুষটির কাছে সঙ্গীতই ছিল সেই অস্ত্র। অতুলপ্রসাদের জীবন আর গান যেন মিলে যায় এক বৃহৎ উদ্দেশ্যের মঞ্চে।
Powered by Froala Editor