নিজবালিয়ায় দুর্গা পূজিত হন সিংহবাহিনী রূপে

মুঘল আমলে বাংলাসহ অন্যান্য রাজ্যে বিভিন্ন পরগনা গঠন করেছিলেন সম্রাট আকবর। বালিয়া পরগনা তাদের মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম প্রশাসনিক বিভাগ। একদা রাজস্বের পরিপক্ক উৎস এই বালিয়া। বিভাগের অন্তত সাত-আটটি গ্রামের নামের সঙ্গে ‘বালিয়া’ শব্দটি একেবারে হরিহর আত্মা। এর মধ্যে এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে জীবন্ত নিজবালিয়া। জগৎবল্লভপুর ব্লকের পাঁতিহাল গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে নিজবালিয়া। প্রায় চার শতাব্দী আগে এই নিজবালিয়া ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও আর্থিক কেন্দ্র।

আজ, গ্রামটি তার প্রাচীন সিংহবাহিনী মন্দিরের জন্য পরিচিত। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসই নয়, ঐতিহ্যের জন্যও গবেষকদের নয়নের মণি এই মন্দির। মন্দিরটি ৪০০ বছরেরও বেশি পুরনো। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল এবং বলরাম চক্রবর্তীর কালিকামঙ্গলের মতো বহু মহাকাব্যে সিংহবাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮ শতকে বর্ধমানের মহারাজা এই জমি দখল করার পরে, জমি এবং মন্দিরটি নিজবালিয়ায় সেবায়েত পরিবারকে দান করা হয়েছিল।

তবে, মন্দিরটি কার তৈরি, সে-বিষয়ে সঠিক কোনো তথ্য। রামকৃষ্ণ রায়ের শিবায়ন কাব্যে আমরা দেখতে পাই, মন্দিরের সেবায়েত যাদবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বংশধরদের নামে ছিল জমি ও মন্দির। পরগনা বর্ধমান জমিদারদের দখলে যাওয়ার পর চিত্রসেন যাদবেন্দ্রনাথের বংশধরদের জমিটি পুনরায় দান করেছিলেন। একই পরিবারের বংশধরেরা এখনও মন্দিরে সেবায়েত হিসেবে কাজ করে।

রাজা সিংহবাহিনীর সম্পত্তি হিসেবে কয়েক একর জমি দান করেছিলেন। দেবোত্তর সম্পত্তিতে এত জমি ছিল যে, এক বিঘা থেকে উৎপাদিত ফসল একদিনে দেবীর নৈবেদ্যে চলে যেত। তবে, এর কোনোটিই এখন আর অবশিষ্ট নেই। বর্তমানে মন্দিরটি পরিচালনার দায়িত্ব ট্রাস্টি বোর্ডের। সিংহবাহিনী নিয়ে রয়েছে নানান জনশ্রুতি। সে-সময়ে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল মহামারি— ওলাউঠা। রোগ থেকে মুক্তি পেতে গ্রামে গ্রামে সিংহবাহিনীর পুজো শুরু করেন মানুষ। এভাবেই সম্ভবত মন্দিরের পত্তন।

আরও পড়ুন
দশঘড়ার বিশ্বাস পরিবারের দুর্গাপুজো

নিজবালিয়া, গড়বালিয়া, যমুনাবালিয়া, নিমাবালিয়া, বাদেবালিয়া এবং হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের পার্শ্ববর্তী গ্রামসহ হুগলি জেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলির পাঁচটি গ্রামের মানুষের মধ্যে সিংহবাহিনী খুবই জাগ্রত। একসময় এই সমস্ত এলাকা বর্ধমান মহারাজার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপুজো। দেবী সিংহবাহিনীই পাঁচদিন (ষষ্ঠী থেকে দশমী) দুর্গা রূপে পূজিত হন।

আরও পড়ুন
বাঙালির ‘মাই’ ও কিছু টিপ্পনী

প্রতিমা নিম কাঠের। তিনি অষ্টভুজা। কাঞ্চনবর্ণা। উচ্চতা দেড় মিটার। শ্বেত সিংহের উপর বসে। ডান দিকের হস্তসমূহে অসি, বাণ ও পাশ। বাঁদিকে ঢাল, ধনুর্বাণ, শঙ্খ। বাকি বাম ও ডান হাত বর ও অভয়মুদ্রা। চালচিত্রের মাথায় মহাদেব। রয়েছেন নন্দী। দশমহাবিদ্যা ও বিষ্ণুর দশাবতারও অঙ্কিত। নিজবালিয়ার পাশ্ববর্তী গ্রাম পাঁতিহাল। এখনকার সৌপ্তিক ব্যানার্জি লিখছেন, ‘বর্ধিষ্ণু রায় পরিবারে অনুরূপ সিংহবাহিনী দুর্গার মূর্তিতে শারদীয়া দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। তাই তাঁরাও দুর্গা নবমীতে প্রথা মেনে পুজো দিয়ে যান। লোকমুখে দেবীকে নিয়ে অনেক মাহাত্ম্য প্রচলিত আছে। দেবীর বাৎসরিক উৎসব অর্থাৎ, সীতানবমী তিথিতে সকালে বহু মানুষ বাঁকে করে সূদুর গঙ্গা থেকে হেঁটে গঙ্গাজল নিয়ে আসেন মোক্ষ লাভের আশায়। দেবীর মন্দিরের ভিতর সিংহবাহিনীর পাশে কষ্টিপাথরের বিষ্ণু মূর্তি বাসুদেব জ্ঞানে পুজিত হচ্ছে।’

প্রতি ১২ বছর অন্তর নতুন করে প্রতিমা গড়া হয়। মন্দিরটি বাংলার ঐতিহ্যবাহী আটচালা শৈলীতে তৈরি। রয়েছে নাটমন্দিরসহ প্রসারিত অলিন্দ। নাটমন্দিরে চোখে পড়বে একটি চার পঙ্ক্তির লিপি। লেখা রয়েছে— ‘শ্রীরামনারায়ণ মারিক/ সাং কলিকাতা সকাবদা ১৭১২ সন ১১৯৭ সাল/ মাস অগ্রহায়ণ।’ অনেক ঐতিহাসিকই বলেন মন্দিরের নির্মাণকাল অন্ততপক্ষে ষোড়শ শতক। যাই হোক, পুরনো মন্দিরের কিছু অংশ মেরামত করে আবার রং করা হয়েছে। মন্দির সংলগ্ন একটি বিশাল পুকুর। প্রতিদিন সকালে এই পুকুরের চারপাশে এবং মন্দিরের পিছনে একটি বাজার বসে। সিংহবাহিনীকে নিত্য নিবেদনের জন্য সমস্ত শাকসবজি আসে এই বাজার থেকেই। নিত্য নৈবেদ্যে মাছ অপরিহার্য। স্থানীয় পুকুর থেকে মাছ ধরা হয়।

বাংলা ক্যালেন্ডারের বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত সীতা নবমী, রাম নবমীর এক মাস পর মন্দিরের বার্ষিক উৎসব। হাজার হাজার মানুষ মন্দিরে আসেন পুজো দিতে। এ বছর উৎসবের ৮৩ বছর উদযাপিত হয়েছে। মন্দির ঘিরে আয়োজিত হয় বিশেষ অন্নকুট উৎসবও। শামিল হন হাজার হাজার মানুষ। অন্নকুটের সময় মন্দিরে আসা ভক্তদের মধ্যে খিচড়ি, ভাজা এবং পায়েসের মালসা বিতরণ করা হয়। জমকালো মেলাও বসে উৎসবকে কেন্দ্র করে।

Powered by Froala Editor