এক সময়ে এদেশের ক্লাবগুলিতে লেখা থাকত, ‘কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। বহুল প্রচলিত সেই কাহিনি। ভারতের মানুষকে জীবজন্তুর থেকে আলাদা করে দেখতে শেখেনি একাংশের ইংরেজ। ব্যতিক্রমী মানুষ অবশ্যই ছিলেন। কিন্তু তাঁদের মহৎ কর্মের পাশাপাশি রয়ে গেছে ব্রিটিশ শাসনের কালো ইতিহাসটাও। তুল্যমূল্য বিচারে হয়তো পাল্লা ভারি হবে সেদিকেই। আর যাঁরা সেদিন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য, যাঁদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল দেশমাতৃকার মন্ত্র, তাঁদের উপর নেমে এসেছিল নৃশংস অত্যাচার। বিনাবিচারে জেলে বন্দি থাকতে হয়েছে দীর্ঘদিন, বিচারের নামে প্রহসনে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছে কত স্বাধীনতা সংগ্রামী। ক্ষমতার দর্প এতটাই আকাশ ছুঁয়েছিল যে, একটা গাছকে পর্যন্ত বন্দি করেছিল ইংরেজ পুলিশ।
হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল একটি বটগাছকে (Banyan Tree)। আর সেই অবস্থাতেই আজও সযত্নে রেখে দেওয়া হয়েছে সেই গাছটিকে। ব্রিটিশ অপশাসনের স্বেচ্ছাচারিতার দিনগুলিকে প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে ভারতে নয়, বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার প্রদেশের লান্ডি কোটাল (Landi Kotal) শহরে দেখা মিলবে গাছটির। তখন অবশ্য অবিভক্ত ভারতেরই অংশ ছিল সেটি। আর গাছটির গায়ে আজও ঝুলে রয়েছে ইংরেজ আমলের সাইনবোর্ড ‘আই অ্যাম আন্ডার অ্যারেস্ট’।
কিন্তু কী ‘অপরাধ’ ছিল গাছটির? তার জন্য পিছিয়ে যেতে হবে ১৮৯৮ সালে। লান্ডি কোটালে তখন ছিল ইংরেজ সেনানিবাস। গোটা দেশই তাদের দখলে, স্বাধীনতা আন্দোলনও বৃহত্তর রূপ নেয়নি। ফলে কাজের থেকে সেনারা বেশি ব্যস্ত থাকত আমোদ-আহ্লাদে। ছুটত মদের ফোয়ারা। সেরকমই এক রাতে একটু বেশিই নেশা করে ফেলেছিলেন অফিসার জেমস স্কুইড। মদের ঘোরে মনে হল, বটগাছটি যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে। যে কোনো মুহূর্তে করতে পারে আক্রমণ। সঙ্গে সঙ্গে গাছটিকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হয়। যেমন বলা, তেমন কাজ। অধস্তন কর্মচারীরা শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলে গাছটিকে।
নিশ্চয়ই পরদিন সকালে নিজের কাজে হাসি পেয়েছিল স্কুইডের। ‘মুক্তি’ দিতে কি বলেছিলেন গাছটিকে? অন্তত, যে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের তাই করা উচিত ছিল। কিন্তু হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। ওভাবেই ‘বন্দি’ অবস্থায় বছরের পর বছর কাটিয়ে দিল গাছটি। এক মাতাল সেনা অফিসার যে বোকামির কাজ করেছিল, জারি রইল সেই ব্যবস্থাই। এরপর বুদ্ধিমান কোনো অফিসার কি আসেননি সেই সেনানিবাসে? কারোর মনে হয়নি এই হাস্যকর সিদ্ধান্ত তুলে নেওয়ার কথা? আসলে, গাছবন্দি করার বিষয়টিকে ওই অঞ্চলের ইংরেজ প্রতিনিধিরা দেখাতে চেয়েছিলেন একটি প্রতীক হিসেবে। স্থানীয় উপজাতিদের সরাসরি আঘাত না করেও, তৈরি করতে চেয়েছিলেন ভয়ের বাতাবরণ। বিশেষ করে পাস্তুন সম্প্রদায়ের মানুষরা কোনোভাবেই মেনে নেয়নি ব্রিটিশ রাজত্বকে। আচার-আচরণে বুঝিয়ে দিত নিজেদের বিরোধী মনোভাব।
আরও পড়ুন
'মানব শিকারি' ব্রিটিশদের আরেক উপাখ্যান 'মানগড় গণহত্যা'
তাই গাছটিকে ব্যবহার করা হল ‘ফ্রন্টিয়ের ক্রাইমস রেগুলেশন’-এর (FCR) রূপক হিসেবে। যে আইনে বলা ছিল, কোনো জনজাতি সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তিও যদি ব্রিটিশবিরোধী পদক্ষেপ নেয়, তাহলে সমগ্র জাতিকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাখে ব্রিটিশ সরকার। সেক্ষেত্রে কোর্টের কোনো অনুমতি প্রয়োজন পড়বে না। এমনকি জনজাতিভুক্ত মানুষেরা আপিল করতে পারবে না, উকিল নিয়োগের অধিকারও থাকবে না। অর্থাৎ বিনা দোষে, বিনা বিচারে শাস্তিভোগ করতে হবে তাদের। এবং তার সময়সীমা সরকারের মর্জিমাফিক। বটগাছটিকেও তো ঠিক একইভাবে সাজা দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন
১৫০০ আদিবাসীকে নির্মম গণহত্যা ব্রিটিশের, আরেক জালিয়ানওয়ালাবাগের কাহিনি
সেই সময়ে গাছটি ছিল খোগিখেলি সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির জমিতে। পরে সেই জায়গাটিও দখল করে নেয় ইংরেজরা। তারা বিদায় নেওয়ার পর মূলত আফ্রিদি সম্প্রদায়ের মানুষরাই বসবাস শুরু করে লান্ডি কোটালে। গাছটিকে শিকলবদ্ধ অবস্থাতে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। পরবর্তী প্রজন্মকে অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। ঘটনাচক্রে গত দশক পর্যন্ত পাকিস্তানে বলবৎ ছিল এফসিআর। স্থানীয় উপজাতিদের উপর বহুবার প্রয়োগ হয়েছে এই আইন। বটগাছটির মতোই অসহায়ভাবে সাজা পেতে হয়েছে তাদের। যা প্রমাণ করে, আসলে সব শাসকই মাতাল। কেউ স্কুইডের মতো মদে মাতাল, কেউ-বা ক্ষমতার দম্ভে।
Powered by Froala Editor