রাজনীতির ময়দান ছেড়ে বিপ্লবী অরবিন্দই হয়ে উঠেছিলেন ঋষি অরবিন্দ। পন্ডিচেরিতে আশ্রম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন শান্তির বার্তা। স্বপ্ন ছিল, এমন এক সমাজ ব্যবস্থা হবে যেখানে ধর্মীয় ভেদাভেদ নেই কোনো, নেই কোনো জাতিগত কিংবা রাজনৈতিক বিদ্বেষ। সমাজের প্রত্যেক মানুষই কাজের প্রকার নির্বিশেষে সমপরিমাণ বেতন পাবেন, কেননা কোনো কাজই ছোটো নয়। না, ইউটোপিয়া নয়। এমন শহরের অস্তিত্ব রয়েছে বাস্তবেও। এই ভারতের মাটিতেই।
পন্ডিচেরির সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে তামিলনাড়ুর ভিলুপুরম জেলার একাংশ নিয়েই তৈরি এই স্বপ্নরাজ্য ‘অরোভিল’ (Auroville)। হ্যাঁ, ঋষি অরবিন্দর নামানুসারেই এই শহরের নামকরণ। তবে ‘অরোর’ কথাটির ফরাসি অর্থ ও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যার মানে ‘ভোর’। কাজেই অরোভিল ‘সিটি অফ ডন’ বা ‘ভোরের শহর’ নামেও পরিচিত। অরোভিল যেন শান্তি, প্রগতি এবং ঐক্যের নবসূর্যোদয়েরই প্রতীক। আর এই শহরের নেপথ্যে রয়েছেন অরবিন্দেরই ফরাসি বংশোদ্ভূত সহকারী তথা শিষ্যা মিরা আলফাসা। অরবিন্দের মৃত্যুর পর তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতেই এই ঐক্যের শহর গড়ে তুলেছিলেন মিরা। আজ যেখানে বসবাস বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশের নাগরিকদের।
১৯৬৮ সালে পথচলা শুরু হয়েছিল অরোভিলের। খোলা মাঠের মধ্যে বটগাছের তলায় হাজার পাঁচেক মানুষকে নিয়ে এই শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন মিরা আলফাসা। সেদিন উপস্থিত ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন ১২৪টি দেশের নাগরিক। আদেশ ছিল সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে নিজের দেশের মাটি। আরোভিল শহরের কেন্দ্রে আজও সেইমাটি সংরক্ষিত রয়েছে প্রকাণ্ড একটি পাথরের পাত্রে। যা মিলন এবং একতার প্রতীক। ১৯৬৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অরোভিল প্রতিষ্ঠা হলেও, তার বছর তিনেক আগেই প্রথম এই নগরী তৈরির কথা উপস্থাপন করেন ভারত সরকারের কাছে। ভারত সরকারের হাত ধরেই এই শহরের পরিকল্পনার কথা উপস্থিত হয়েছিল ইউনেস্কোর দরবারে।
বর্তমানে এই শহরে স্থায়ী বাসিন্দাদের সংখ্যা হাজার ছয়েক। যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষই বিদেশি। তবে শুধু এই শহরের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রই নয়, রীতিমতো অবাক করে এই শহরের পরিকাঠামো এবং সমাজ ব্যবস্থাও। বৃত্তাকার এই শহরের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে উপাসনালয়, অ্যাম্ফিথিয়েটার এবং সুদৃশ্য বাগান। একটু অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, যে শহরের নাগরিকদের কোনো ধর্ম নেই, সেখানেও রয়েছে উপাসনালয়। তবে কোনো আরাধ্য দেবদেবীর মূর্তি নেই সেখানে। নেই কোনো ধর্মীয় আচারব্যবস্থাও। এই উপাসনালয়ে শুধুমাত্র মেডিটেশনের জন্য হাজির হন নগরবাসীরা। উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে রয়েছে ১৮৯ হেক্টর এলাকার আবাসিক অঞ্চল। তার বাইরে আন্তর্জাতিক প্যাভিলিয়ন এবং সাংস্কৃতিক এলাকা। এই অঞ্চলেই রয়েছে আবাসিকদের শিশুদের জন্য স্কুল। সেখানে হাজির হলে স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যাবে শান্তিনিকেতনের। তাছাড়া গোটা অঞ্চলটিই শিল্পীদের জন্য স্বপ্নরাজ্য। নিজের ইচ্ছে মতো শিল্পসাধনা করার জায়গা। অরোভিলের সবচেয়ে বাইরের অংশে রয়েছে প্রায় সাড়ে চারশো হেক্টর অঞ্চলের অরণ্য। যা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত 'গ্রিন বেল্ট' নামে। এখানেই উৎপাদিত হয় নানারকম ভেষজ উদ্ভিদ। বন্যপ্রাণীদের
আশ্চর্যের বিষয় হল, এত বড়ো নগরীতে আলাদা করে কোনো শাসনব্যবস্থা নেই। নেই অপরাধও। চলে না অর্থও। শহরবাসীদের জন্য সেখানে প্রচলিত ‘অরোকার্ড’ নামের এক বিশেষ প্লাস্টিক মানি। অরোভিলের ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট থাকলে সমস্ত নগরবাসীই দৈনন্দিনের চাহিদার সমস্ত সামগ্রী পেয়ে যান সেখান থেকে। কিন্তু অর্থ ছাড়াই কীভাবে চলে এই নগর?
মিরার মৃত্যুর পর ১৯৮০ সালে এই শহরের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারত সরকার। শহরের অর্থনীতির ২৩ শতাংশ অনুদান আসে সরকারি তহবিল থেকেই। বড়ো অঙ্কের অনুদান প্রদান করে ইউনেস্কো। তাছাড়াও পর্যটকদের আনাগোনা এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদের তৈরি শিল্পসামগ্রীর রপ্তানি তো আছেই। এখনও পর্যন্ত অরোভিলের বাসিন্দা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির জন্য প্রায় দশ হাজারেরও বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এই গ্রাম। এইসব মিলিয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে অরোভিলের অর্থনীতি।
তবে মাটিঘেঁষা হলেও প্রযুক্তির দিক থেকে ভারতের উন্নত মেট্রো শহরগুলিকেও রীতিমতো টেক্কা দেয় অরোভিল। দূষণমুক্ত এই শহরে বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় সোলার প্যানেল। সৌরশক্তি কাজে লাগিয়েই হয় রান্না। তাছাড়া সমস্ত ইন্টারনেট থেকে শুরু করে সমস্তরকমের প্রযুক্তিগত পরিষেবাই উপলব্ধ এই শহরে। আগামীদিনে ভারতের নবজাগরণের কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠবে এই শহর, এমনটাই স্বপ্ন ছিল অরবিন্দের। আক্ষরিক অর্থেই সেই স্বপ্নপূরণের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে অরোভিল…
Powered by Froala Editor