রাস্তার ধারে খাবারের দোকান। সেখানে একটি পাথরের স্ল্যাব। এমনটা তো থাকতেই পারে। কিন্তু যে ছেলেটি খাবারের জন্য এসেছে, সে প্রত্নতত্ত্বের ছাত্র। পাথরের খণ্ডটা দেখেই সন্দেহ হয় তার। পাথরটার উপর যেন দুর্বোধ্য হরফে কীসব লেখা! সেসব লিপি তার খানিকটা চেনা চেনা লাগে। দোকানদারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এই পাথরটি স্থানীয় একটি পশু খামারের মালিকের। সেখানে ছেলেটির জন্য অপেক্ষা করছিল আরও এক বিস্ময়। সেই পাথরের বাকি অংশে আছে একটা ছবি। পোশাক দেখে মনে হয় ঠিক যেন মায়া সভ্যতার বজ্রের দেবতার ছবি। কিন্তু কোত্থেকে এল এই পাথর? জানা গেল, খামার তৈরির আগে এই জায়গাটা পরিষ্কার করতে গিয়েই পাথরের খণ্ডটি খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
আরও পড়ুন
পুরনো মাটির বাড়ি ভাঙতে গিয়ে উদ্ধার রবীন্দ্রনাথের চিঠি
স্নাতক স্তরের ছাত্রটি এই কথা তার শিক্ষকদের জানায়। আর তারপরেই শুরু হয়ে যায় অনুসন্ধান। অবশ্য এতো পুরনো কোনোকিছুর হদিশ পেতে গেলে মাটির নিচে খননকার্য চালাতে হবে। তার জন্য স্থানীয় মানুষদের অনুমতি দরকার। সেটা সহজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে কয়েক বছরের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল অনুমতি। খননকার্য শুরু হল ২০১৮ সালে। আর তারপর যা পাওয়া গেল, তা দেখে বিস্মিত প্রত্যেকেই। মাটির নিচে আস্ত একটা শহর। আয়তন যদিও খুব বেশি নয়। মোটামুটি ৬০০ মিটার লম্বা আর ৪০০ মিটার চওড়া একটা শহর। তবে তার মধ্যে আছে পিরামিড, রাজপ্রাসাদ, ছোটবড় অনেক বাড়ি। এমনকি এই প্রাচীন শহরেও নাগরিকদের বিনোদনের জন্য আছে একটা বল-কোর্ট।
আরও পড়ুন
৩৪০০ বছর আগেকার রাজ্যের সন্ধান মাটির নিচে, পাওয়া গেল শিলালিপিও
দীর্ঘ গবেষণার পর ঐতিহাসিকদের অনুমান, এই শহর ছিল প্রাচীন সাক জাজি রাজত্বের রাজধানী। যদিও তেমন বড়ো কোনো সাম্রাজ্য নয়, একটা নগরকেন্দ্রিক রাজত্ব। অনেকটা আমাদের দেশের প্রাচীন ষোড়শ মহাজনপদের মতো। এই রাজত্ব টিকেছিল বহুদিন। আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে প্রায় ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এখানে মানুষের বসবাস ছিল। নাগরিকের সংখ্যাও ছিল ৫০০০ থেকে ১০০০০। এখন মেক্সিকো আর গুয়াতেমালার সীমান্তে মাটির নীচে পড়ে আছে তারই ধ্বংসস্তূপ।
আরও পড়ুন
চাঁদের মাটিতে মিশে আছে যে বিজ্ঞানীর অস্থিভস্ম
বেশ শক্তিশালী রাজত্ব ছিল এই সাক জাজি। আশেপাশের অনেক শহরের পুরনো শিলালিপিতে সাক জাজি রাজত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেক রাজত্বের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহও লেগে থাকত। আবার সামরিক চুক্তিও ছিল অনেকের সঙ্গে। খুব শক্তিশালী রাজত্ব ছিল, এমন নয়। তবে এত দীর্ঘ সময় টিকে থাকার পিছনে দক্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা তো ছিলই। তবে ঐতিহাসিকরা এই শহরের সন্ধান না পেলেও স্থানীয় অনেক চোরাকারবারি এর হদিশ জানতেন বলেই অনুমান বিশেষজ্ঞদের। অনেক মিনার, অনেক শিলালিপিই তাঁরা চুরি করে নিয়ে গিয়েছেন। পৃথিবীর নানা জায়গায় বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় সেসব নমুনা খুঁজে পাওয়া যাবে বলেই মনে করছেন গবেষকরা।
আরও পড়ুন
বিস্তীর্ণ জায়গায় ছড়িয়ে ৬০টি ম্যামথের হাড়, রাশিয়ায় প্রাচীন মানুষের ‘কীর্তি’
তবে দেরিতে হলেও, এই আবিষ্কার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এমনটাই মত গবেষকদের। কীভাবে চলত এখানকার মানুষের সারাদিন? অসংখ্য শক্তিশালী সাম্রাজ্যের মাঝে কীভাবে টিকে ছিল দীর্ঘ ১৬০০ বছর? এইসব প্রশ্নের উত্তর আসলে মায়া সভ্যতার ইতিহাসের নতুন পাঠ তুলে ধরবে। প্রত্যক্ষ ইতিহাস বলতে তো ইউরোপীয় বণিকরা প্রায় কিছুই বাকি রাখেনি। আপাতত এইসব ধ্বংসস্তূপ থেকেই যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করা যায়।