‘দাস্তাঁ আগে অওর ভি হ্যায়’: গীত, গজল এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ওপর এক এক সময় বড়ো অভিমান হয়। বিরক্তিও আসে। ওই সাদামাটা ধুতি শার্টের আড়ালে, হাসিমুখে ‘আমি ক্লাসিক্যাল জানি না’ বলে ওঠার আপাত-অনাড়ম্বর সারল্যের গভীরে সারাজীবন লুকিয়ে রাখলেন তাঁর ঐশ্বর্য – বুঝতেও দিলেন না। একদিনের জন্য কলকাতায় এসে ‘শাপমোচন’-এ সুরারোপ করলেন, নিজেই ভাবলেন ‘কিচ্ছু হচ্ছে না’, অথচ ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’-এ লাগালেন বাগেশ্রী, ‘সুরের আকাশে’-তে মূল আধার করলেন শ্যামকল্যাণ, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’-তে জয়জয়ন্তীর সঙ্গে পিলুর মিশ্রণে তৈরি করলেন অনবদ্য সুরবাহার। ‘রাগ অনুরাগ’ ছবির গানে সুর দিতে বসে খেলার ছলে বন্ধু-সহকারীকে বললেন, ‘পটদীপ-টা কী হে, সমরেশ?’ তারপর তিন মিনিটে ওই রাগেই বেঁধে ফেললেন একখানা গান, ‘সেই দুটি চোখ আছে কোথায়’!           

লোকসমাজে প্রচলিত ধারণা – তাঁর ভগবৎদত্ত গলা আর সোজাসাপটা সুরের কারণেই যা কিছু জনপ্রিয়তা। অথচ রাগাশ্রয়ী সুররচনার ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘কালোয়াতি’ না করেও ভারতীয় সঙ্গীতের আত্মাকে তিনি স্পর্শ করেছেন বার বার। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এই স্বল্প পরিসরে নেই, কেবল দু-চার কথা বলা।

তার আগে কয়েকটি তথ্য একটু দিয়ে রাখা ভালো। হেমন্ত রেডিওতে প্রথম গান গেয়েছেন, রেকর্ড বার করেছেন তথাকথিত ‘প্রশিক্ষণ’ ছাড়াই। একটু আধটু নাম ছড়িয়েছে তখন, খুব ইচ্ছে হয়েছিল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত চর্চার। মাসখানেক গান শিখেছিলেন খেয়াল শিল্পী পাঁচুগোপাল বোসের কাছে। তারপর সন্ধান পেয়েছিলেন উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর ছাত্র ফণীভূষণ গাঙ্গুলীর। দু’বছর তাঁর কাছে তালিম। ফণীভূষণবাবু মারা যাওয়ার পর বিভিন্ন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত-শিক্ষকের কাছে গেছেন হেমন্ত, তাঁদের সাফ কথা – ক্লাসিক্যাল শিখতে গেলে ওইসব গান ছাড়তে হবে। ওইসব গান বলতে আধুনিক, ছায়াছবির গান। ততদিনে হেমন্ত গানকেই জীবিকা বলে গ্রহণ করে নিয়েছেন। ‘ওইসব’ না গাইলে জীবন অচল। তাই তাঁর রাগসঙ্গীত চর্চা আর নিয়মিত হয়নি। অনেক পরে, বম্বেতে থাকাকালীন উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের কাছে মাঝে মধ্যে যেতেন তিনি – তবে পেশাগত ব্যস্ততায় সেই যাতায়াতও একসময় বন্ধ হয়ে যায়।  

এখানে একটা কথা ভেবে দেখা দরকার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত আশ্চর্য প্রতিভা – যিনি টেলিফোনে শুনে গান তুলতে পারেন, যিনি একই দিনে, বিকেলে রিহার্সাল দিয়ে সন্ধ্যায় রেকর্ডিং করতে পারেন, যার মুখে ‘ব্যয়ঠি বরাসন’ ভজন শুনে শচীনকর্তা বলেন, ‘আওয়াজখান শুনছস, গায়ে কাঁটা দ্যায়’ তিনি দু-বছর তালিম নিয়েও তাঁর নিজের ভাষায় ‘ক্লাসিক্যালে অজ্ঞ’ থাকবেন, এ কি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য? কেন কমল দাশগুপ্ত তাঁকে দিয়ে কলকাতায় বসে হিন্দি গীত রেকর্ড করালেন, আর কেনই বা একের পর এক গীত-গজলধর্মী গান এক বাঙালি শিল্পীর কণ্ঠে প্রায় নিয়মিত প্রকাশ করে গেল সেকালের অন্যতম সেরা রেকর্ড কোম্পানি? এই জাতীয় গান কি ক্লাসিক্যালে পুরোপুরি অজ্ঞ কোনো শিল্পী সাফল্যের সঙ্গে গাইতে পারেন? অবশ্য তাঁর স্বভাবসিদ্ধ, অনন্যসাধারণ কণ্ঠলাবণ্যের সঙ্গে কষ্ট করে তৈরি রেওয়াজি কালোয়াতি ঠিক মানাত না – একথা তিনি বুঝেছিলেন বলেই বিশুদ্ধ রাগনির্ভর গানের দিকে যাননি, কিন্তু রাগাশ্রয়ী সুররচনা তো করেইছেন, আবার লঘু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত – গীত, গজল জাতীয় গান যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গেই গেয়েছেন। গীত গজলের হেমন্তকুমারকে আমরা  'রেখেছ বাঙালি করে' - সুলভ মানসিকতা  নিয়ে প্রায় ভুলেই থাকি।  কিন্তু বাংলার বাইরে একসময় তাঁকে বেশ  জনপ্রিয়তা দিয়েছিল এই ধারার গান। 

আরও পড়ুন
ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রথম ভারতীয় শিল্পী হেমন্ত, একশো গাড়ির কনভয় অনুসরণ করল তাঁকে

কমল দাশগুপ্তের সুরে হেমন্তের গাওয়া হিন্দি গানগুলির বেশিরভাগই গীতের আঙ্গিকে গড়া। গজলধর্মী সুরের লক্ষণ অনেক বেশি স্পষ্ট তারসেম লালজি, রবিশঙ্কর শর্মা এবং হেমন্তকুমারের নিজের সুরারোপিত গানগুলিতে। রাগসঙ্গীতের প্রয়োগদক্ষতার বিচারে কিন্তু গীতের চেয়ে গজলের গায়কি বেশ কিছুটা জটিল। ‘কল তেরি তসবীর কো’ – কথা হসরত জয়পুরী, সুরারোপ করেছেন রবিশঙ্কর শর্মা। গজলটি নিতান্ত সহজ নয়, কিন্তু অসাধারণ আবেদনে এ গান পরিবেশন করেছেন হেমন্ত। তাঁর নিজের সুরে মধুকর রাজস্থানীর কথায় ‘তুমনে মুঝকো সদা জলায়া’ – সে সময়ের গজলে চার তুকের প্রয়োগে এক নতুন ধারার সন্ধান দিয়েছিল। আরও একটি অনবদ্য গজল ‘উয়ো সাথ হমারা দে ন সকে’ - সুরের ধারায় রাগসঙ্গীতের প্রভাব, কিন্তু প্রয়োগে বাংলা কাব্যগীতির আভাস ধরা পড়ে। প্রথম লাইনের শেষে ‘দে ন সকে’ – এক ধরনের অপূর্ণতা প্রকাশ পাচ্ছে এখানে; সেই অসম্পূর্ণতা ফুটিয়ে তুলতে তিনি ব্যবহার করলেন স ন স র র র গম গমগ র ম ম। মধ্যমে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠল বিচ্ছেদ ও অসহায়তা। বাণীর অন্তর্নিহিত ভাবকে কাব্যরসিক শিল্পী অনায়াস দক্ষতায় শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন রাগসঙ্গীতের নির্যাস আত্মস্থ করে। কিন্তু শুনলে মনে হয় কী সাবলীল আর সহজে মর্মস্পর্শী! 

আরও পড়ুন
শুধু উত্তমকুমারই নন, অন্যান্য নায়কদের কণ্ঠেও অবিস্মরণীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

বাংলা ও হিন্দি ছবির গানেও বেশ কয়েকবার তিনি গীত ও গজলধর্মী সুর ব্যবহার করেছেন – আমরা সেসব গান শুনে মুগ্ধ হই, কিন্তু তলিয়ে ভাবি না। ‘ন ইয়ে চাঁদ হোগা’-তে রয়েছে গীত-ঘরানার চলন, আবার ‘দিল ছেড় কোই’ গানটিতে পাই গজল-আঙ্গিক – জৌনপুরী রাগে। ‘নারসি ভগৎ’ ছবিতে ‘দরশন দো ঘনশ্যাম’ তাঁর সুরে একটি অনবদ্য কেদার-রাগাশ্রিত ভজন – গেয়েছেন তিনি নিজে লতাজির সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে, শেষে একটু গলা মিলিয়েছেন মান্না দে-ও। তাঁর সুরে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘তোমাদের আসরে আজ এই তো প্রথম গাইতে আসা’ – গানটিতেও গজল-ধারার প্রয়োগ একটু মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায়। সুরকার শুরু করলেন মাইনর কর্ড দিয়ে – প ম গ র ন – এই সব স্বর নিয়ে খেলা করছেন। অন্তরায় হঠাৎ কড়ি মা থেকে শুরু করছেন – ম গ র স ন ধ স। রাগ য়মনে চলে যাচ্ছেন – টনিক চেঞ্জ করে স্থায়ীর ‘রে’-কে করে দিচ্ছেন সা। এর পরেই আবার তারসপ্তকের ষড়জে উঠে গিয়ে কোমল ধৈবত দিয়ে নেমে এলেন। তারপর কোমল নিখাদ লাগিয়ে যে মূর্ছনা তৈরি করলেন তা অনেকটা রাগ চারুকেশীর আভাস নিয়ে আসে। 

আরও পড়ুন
‘ফাইনালি যখন কাজটা আমিই করছি, আমিই আবহ সঙ্গীত রচনা করি’; সুরের জাদুর সেই শুরু

গানের সঙ্গে তালযন্ত্র হিসেবে তবলা বাজছে - বাদনশৈলীও গজল আঙ্গিকের। প্রিলিউড, ইন্টারলিউড একটু অন্য রকম, কিন্তু অন্তরায় আবার ফিরে আসছে গজলের বিন্যাস। ‘এতদিন তানপুরাটার যে তারগুলো নীরব ছিল’ - এই পঙক্তির সুরে ঘটে যাচ্ছে টনিক চেঞ্জ – অর্থাৎ স্থায়ীর সুর যে সপ্তকে বাঁধা ছিল, তা থেকে সম্পূর্ণ অন্য সপ্তকে চলে গেছে। এও গজল আঙ্গিকের আদলে। 

আরও পড়ুন
অনশন শুরু করলেন জেলবন্দি নজরুল, প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম রবীন্দ্রনাথের

‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’ গানটি বহুপ্রচলিত – শুনলে মনে হয় খুব সরল সুর। কিন্তু এর আরম্ভের স্বরসঙ্গতি নিয়ে একটু তলিয়ে ভাবলে পরমেশ্বরী রাগের আভাস ধরা পড়ে – পঞ্চম বর্জ্য, কোমল নিখাদ, গান্ধার আর রেখাব। পরমেশ্বরী প্রচলিত রাগ নয়। একটি দক্ষিণ ভারতীয় ঠাট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পণ্ডিত রবিশঙ্কর এটিকে জনপ্রিয় করেন, যা প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। 

আরও পড়ুন
সত্যজিতের পঞ্চরথী – যাঁদের ছাড়া ‘অসম্পূর্ণ’ থেকে যেত কালজয়ী সিনেমাগুলি

অন্যদিকে, ১৯৫৭ সালে মরাঠি ছবি ‘নায়কিনিচা সজ্জা’তে হেমন্ত্কুমার লতাজিকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘নশিভি মাতে’, আর এই গানটির সুরেই ‘লুকোচুরি’(১৯৫৮)ছবিতে নিজে গাইলেন ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’। ১৯৫৫-৫৬ নাগাদ হেমন্ত বাংলা-হিন্দি ছবির পাশাপাশি তামিল ছবিতেও সঙ্গীত পরিচালনার কাজে প্রায়ই মাদ্রাজ যাতায়াত করতেন। হয়তো কোন স্থানীয় শিল্পী বা যন্ত্রীর কাছে ওই দক্ষিণ ভারতীয় ঠাটটি শুনে কোনভাবে তাঁর মনে রেখাপাত করেছিল এই জাতীয় স্বরসঙ্গতির অন্তর্নিহিত স্মৃতিমেদুরতা ও বিষণ্ণতার সুর। পরবর্তী কালে ‘পরমেশ্বরী’ রাগ হিসেবে যা পরিচিত হল, সেই রাগরূপের আভাস-সহ অভিনব স্বরসঙ্গতির প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’তে। প্রথম  লাইনে লাগালেন কোমল রেখাব আর নিখাদ, পঞ্চম নেই। ‘মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়’-এ শুদ্ধ গান্ধারের প্রয়োগে কিছুটা আহির ভৈরবের ছোঁয়া এনে একটু পরেই বৈরাগীতে চলে যাচ্ছেন। আবার ‘প্রথম দেখার স্মৃতি’-তে ‘টনিক চেঞ্জ’ করে মধ্যমকে ‘সা’ করে শিবরঞ্জনীর ছায়া নিয়ে এসেছেন। অন্তরার শেষের দিকে আবার ফিরে আসছেন পরমেশ্বরী রাগে। এভাবে ছোট ছোট গতিতে, সূক্ষ্ম কায়দায় এক রাগ থেকে অন্য রাগে অনায়াস গতায়াত - গজলের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। 

উস্তাদ আমির খাঁ, মেহদি হাসান প্রমুখ ছিলেন তাঁর সুর ও কণ্ঠের অনুরাগী, অনুজ গজল শিল্পীদের মধ্যে জগজিৎ সিংজিও তাঁর প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। হৈমন্তী শুক্ল বলেছেন, ‘রাগসঙ্গীতে হেমন্তদার জ্ঞান কোন অংশে কম ছিল না, কিন্তু কালোয়াতি নিয়ে দেখনদারি তিনি পছন্দ করতেন না।’ আর একটি ঘটনার কথাও বলি – একবার এক অনুষ্ঠানে হৈমন্তী পুরিয়া ধানেশ্রী রাগে একটি ভজন গেয়ে শেষ করলেন। তার পরেই হেমন্ত মঞ্চে উঠে ধরলেন ওই রাগেই একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। আসর মাত করে নেমে বললেন অনুজা শিল্পীকে – ‘তুই তো শুরুটা করেই দিয়েছিস, শেষটা আমি করলাম।’ 

এর পর আর কিছু বলার থাকে না, তবু আর কয়েকটি গানের কথা না বললেই নয়।  

হেমন্ত্ কুমারের গীত-গজলধর্মী গানের একটি বিশেষ ধারায়  মণিমুক্তোর মত কথা বসিয়ে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন কাইফি আজমি, গুলজার-এর মত কবি। কাইফি আজমির কথায় ‘ন বজাই হো’ ভজন-গীতটি সুরকার হেমন্তর এক অনবদ্য সৃষ্টি। দেশে বিদেশে বিভিন্ন আসরে এ গান তাঁকে স্বকণ্ঠেও গাইতে হয়েছে একাধিক বার – বাহারি তানকর্তব না করেও, ছোট ছোট আলাপ, আবর্তন আর খটকা তিনি যেভাবে অবলীলায় প্রয়োগ করেছেন তা বোদ্ধা শ্রোতাদেরও বিস্ময় জাগাতে পারে। 

বাংলা গানের জগতে তাঁর পরিচিতি ছিল ' lyric conscious artist'  হিসেবে। হিন্দি বা উর্দুতেও কি তাই নয়?  কিন্তু এ দিকটি  অনেকাংশে আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। উর্দু তিনি নিজে সেভাবে জানতেন না, তবে গানের কথা, ভাব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বুঝে নিতেন গীতিকারের কাছে।  আর সুর করতেন সেই বাণীর অর্থকে মান্যতা দিয়েই।  এভাবে সৃষ্টি করেছেন এক একটি অনবদ্য গজলধর্মী গান। গজল কথাপ্রধান গান, তাই অভিব্যক্তিময় উচ্চারণে শের-এর অন্তর্গত প্রতিটি শব্দের ব্যঞ্জনা এবং নাটকীয়তা সমেত যাবতীয় 'দর্দ'  গায়নে ফুটিয়ে তোলাও শিল্পীর দায়িত্ব। রাগ থেকে রাগান্তরে যাওয়া গজলের আর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গুলজারের লেখনীতে ভর করে হেমন্তর সুরে এবং কণ্ঠদানে  'আভি না পর্দা গিরাও ঠেহরো'  আর 'গিরা দো পর্দা' - দুটি গান অবিস্মরণীয়। প্রথমটিতে ব্যবহার করেছেন  বাগেশ্রী - বড় প্রিয় রাগ তাঁর। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের নির্জনতা ফোটালেন কণ্ঠস্বরে।  পর্দার আড়ালে থেকে যাওয়া রহস্যের আভাসকে আড়ালেই থাকতে  দাও - একথাই বলা হচ্ছে গানের বাণীতে।  'ঠেহরো'  শব্দটিতে এসে থেমে যাচ্ছে সুরবিস্তার, শেষ হয়েও যেন শেষ হচ্ছে না।  এ গানের অসমাপ্ত বক্তব্যকেই যেন পূর্ণতা দিচ্ছে দ্বিতীয় গানটি। যা আগের সন্ধ্যায়, রাতে ছিল পর্দার আড়ালে, তাকে যেন আর ঢেকে রাখা যাবে না। সেই ভাবটির সার্থক প্রয়োগ ঘটালেন মিয়াঁ তোড়ির পঞ্চম-মিশ্র প্রয়োগে - 'গিরা দো পর্দা'। 'খালি হো গ্যয়ি হ্যায়'-তে যে শূন্যতা, রিক্ততার ভাব ফোটালেন স্বরক্ষেপণে - তা এককথায় 'দিল'-এ এসে লাগে সরাসরি। কিন্তু রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের নির্জনতা থেকে পরিপূর্ণ দিনের আলোয় (তোড়ির সময় দিবা দ্বিতীয় প্রহরই!) হৃদয় নগ্ন করে এসে দাঁড়াতে এক সূক্ষ্ম পথরেখা তো প্রয়োজন, তাই দ্বিতীয় গানটির মাঝে একটু লাগিয়ে দিলেন  প্রভাতী ললিত। দুটি গানে দুই মূল রাগের ভিন্নধর্মী  প্রয়োগে সৃষ্টি হল অসাধারণ এক নাটকীয় অভিব্যক্তি।    

এরপরও তিনি বৈষ্ণব বিনয়ে বলবেন,  'রাগ রাগিণী জানি না', আর আমরাও সুবোধ শ্রোতার মত বিশ্বাস করেই যাব। গত ১৬ জুন একশো একতম জন্মবার্ষিকী পূর্ণ হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। এত বছর পেরিয়েও কি উঠবে না এই নিজেকে লুকিয়ে রাখার পর্দা?

Powered by Froala Editor