১৪ মে, এই দিনটা এলেই আমার মনে পড়ে ২০১৩-র সেই সন্ধেবেলাটার কথা, যেদিন আমি একা একটুও ক্লান্ত না হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পদ্মপুকুর থেকে টালিগঞ্জ ফিরে এসেছিলাম অবলীলায়। সেদিনই প্রথম আমি সাহস করে মৃণাল সেনের (Mrinal Sen) বাড়ি চলে গিয়েছিলাম, তাঁকে জন্মদিন উপলক্ষে ফুল দিতে। শুভেচ্ছা জানাতে।
তখন নতুন করে ওঁর সব সিনেমা আবার করে দেখা হচ্ছিল। হঠাৎই ১৪ মে দুপুরে ঠিক করলাম মৃণাল সেনের বাড়ি যাব। কিন্তু উনি থাকেন কোথায়? ঠিকানা কী? তা তো জানি না। আমাদের মতন মধ্যবিত্ত, সিনেমা থেকে শত হস্ত দূরে থাকা অভিভাবক ও আত্মীয়দের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর আউট অফ দ্যা সিলেবাস! সত্যজিৎ রায়ের ঠিকানা যেমন হয়তো সিম্পল হওয়ার জন্যে মানুষের মনে গেঁথে আছে। কিন্তু মৃণাল সেনের ঠিকানা অত চর্চিত নয়। তবুও কে যেন একজন জানিয়েছিল এইটুকুই যে উনি বেলতলা গার্লস স্কুলের কাছেই থাকেন। ব্যাস, বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে একজন সিনেমা অনুরাগী বন্ধুও জুটে গেল।
প্রথমেই টালিগঞ্জ থেকে চলন্ত ট্রামে দৌড়ে উঠে ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে নিজেকে 'ইন্টারভিউ'-এর রঞ্জিত মল্লিক মনে হচ্ছিল। সে ঘোর এক নিমেষেই কাটল কালীঘাটে নামতেই। পকেট হাতড়ে দেখি টাকার ব্যাগটাই নেই! পকেটমারি হয়ে গেছে! বেশি না হলেও তিনশো মতো টাকা ছিল তাতে। কী করব ভেবে পেলাম না। দিকভ্রান্তের মতো খানিকক্ষণ একটু এদিক ওদিক ঘুরলাম। এদেশে পকেট কাটা গেলে কোনো সুরাহা হয় না। বরং 'সুর' কেটে গিয়ে কেবল 'আহা'-টা পড়ে থাকে। পকেট শূন্য। সঙ্গের বন্ধুই মিষ্টি আর ফুল কিনল হাজরা মোড় থেকে। তারপর হেঁটেই বেলতলা গার্লস স্কুলের কাছে গিয়ে তো পৌঁছলাম, কিন্ত কোন বাড়ি সেটা বুঝব কেমন করে? যাকে পাই তাকেই জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম। কেউই কিছু বলতে পারে না। দোকানদার, পাড়ার লোক, ক্লাবের কলার তোলা কাকু সকলেই ভুরু কুঁচকে বা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে—'এখানে থাকতেন নাকি?' নাজেহাল অবস্থা!
একজন ইস্তিরিওয়ালা নিজে থেকেই এগিয়ে এসে আমাদের হাসিহাসি মুখে পান মশলা খাওয়া মূখে বলে— 'মিনাল সেন? মতলব জো ফিলিম বানাতা থা?' বললাম হ্যাঁ। ইস্তিরিওয়ালা আঙুল উঁচিয়ে একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল ওইখানে থাকতেন। কিন্তু এখন আর থাকেন না। কোথায় চলে গেছেন বলতে পারবেন না। তাহলে এবারে কী করি? আমার সঙ্গের বন্ধু জানাল যে তারও ট্যাঁক কিন্তু খালি এই ফুল আর মিষ্টি কিনে। আসলে তখন আর কতই বা হাত খরচ পেতাম বাড়ি থেকে? খরচ ব্যতিরেকে বই বা একটু বেশি টাকার দরকার পড়লে কলেজে আসার আগে মেট্রো স্টেশনে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডবিল বিলিও করেছি। একশো টাকা করে পেতাম রোজ। তাতে আবার কফি হাউজে ট্রিটও দিতাম কী করে কে জানে!
যাই হোক, মৃণাল সেনের সেই 'হয়তো' পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে ঘোরাঘুরি করতে থাকলাম। কী করব ভেবে পাই না। তখনই পাশের এক পুরোনো বাড়ির বারান্দায় এক বয়স্ক মহিলা আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন কাউকে খুঁজছি কিনা। তাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি এক কথায় মৃণাল সেনকে চিনে বললেন— 'ওনারা তো পদ্মপুকুরের দিকে চলে গেছেন। সঠিক ঠিকানাটা বলতে পারব না।'
ব্যাস, তখনই তেড়ে মেরে পদ্মপুকুরের দিকে পায়ে হেঁটেই চলতে শুরু করলাম। ওখানে গিয়ে না হয় আবার জিজ্ঞেস করা যাবে। ক্রমশ কাছে তো পৌঁছচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতেই আমার সেই সঙ্গী বন্ধুর জরুরি কাজের ফোন চলে এল। তাই সে তার পৈতৃক ব্যবসাকে গালাগাল করতে করতে চলে যেতে বাধ্য হল। পড়ে রইলাম আমি আর এক তোড়া ফুল, একটা প্যাকেটে দশটা কড়া পাকের সন্দেশ। একাই পদ্মপুকুর এসে এখানেও এলোপাথাড়ি জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম। অনেকেই চেনেন না, বুঝতেও পারল না কার কথা বলছি। একজন বলে উঠলেন, ‘ওই দিকে যান’, একটা ফ্ল্যাটের দিকে দেখিয়ে বললেন ‘ওই বাড়িতে’। বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। মিনিট কয়েক নিচে দাঁড়িয়ে ভেবে নিচ্ছিলাম কী বলব। পেটের ভেতরটা হালকা হয়ে গিয়ে কীরকম যেন করছিল। নীচে গেটে দারোয়ান আমার হাতে ফুল দেখেই লিফটে উঠিয়ে বোতাম টিপে দিলেন। লিফটের দরজা খুলে গেল। আমিও নির্দিষ্ট ফ্লোরে নেমে ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।
সাহস করে বেল দিলাম। দরজা খুলে গেল। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। একটু অবাক হয়েই আমাকে যিনি জিজ্ঞেস করলেন ‘কাকে চাই’, পরে জেনেছিলাম তিনি মৃণাল সেনের পুত্র কুণাল সেনের স্ত্রী নিশা। একটুও বিরক্ত না হয়েই আমাকে ভেতরে আসতে দিলেন হাসি মুখে। যদিও বেশ বুঝতে পারছিলাম আতিথ্যের সময় পেরিয়ে একটা উদ্ভট সময়ে এসে পড়েছি আমি।
ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়ল বাইরের ঘরের দেওয়ালে সেই অনাহার সময়কার ছবি। একটি বাচ্চা মেয়ে সম্ভবত তার ভাইকে কোলে নিয়ে তাকিয়ে আছে সোজা ক্যামেরার লেন্সের দিকে। যে ছবি দেখিয়েই শুরু হয়েছিল মৃণাল সেনের শেষ ছবি 'আমার ভুবন'। কুণাল সেন এসে জানালেন মৃণাল সেন আসছেন। খেয়াল করলাম একটু দূরের দেওয়ালে বড়ো আরেকটা ছবি। মৃণাল সেন শুটিং করছেন। সিপিয়া টোনের সেই ছবির পাশ দিয়েই বা আরেকটু স্পষ্ট করে বললে নীচ থেকেই সত্যিকারের মৃণাল সেন ওয়াকার নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। আমার হাঁটু কেঁপে ওঠার জোগাড়! এগিয়ে গেলাম ওঁর কাছে। আমাকে হাসি মুখে দেখে প্রথমেই বললেন— 'আমায় কিন্তু প্রণাম করবে না!' নাহ, উনি প্রণাম পছন্দ করতেন না। আমিও করিনি। তবে ফুল আর মিষ্টি দিয়েছিলাম। উনি আমার বসিয়ে নিজেও এসে বসলেন সামনে। তারপর কি যে কথা হল প্রায় মিনিট পনেরো ধরে আমার তার কিছুই মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে আমাকে মন দিয়ে দেখছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কানে একটু কম শুনছিলেন। জোরে কথা বলছিলাম তাই। কোথায় যে মিলিয়ে গেল হাঁটু কাঁপা, কোথায় যে উবে গেল সংকোচ কে জানে। বুঝলাম মৃণাল সেন কাউকেই তার সামনে অপ্রস্তুত করে রাখতে চান না। তাই বয়স নির্বিশেষে সবাইকেই ‘মৃণালদা’ ডাকতে বলতেন।
সন্ধে প্রায় সাড়ে সাতটার সময় বের হয়েছিলাম। পদ্মপুকুর থেকে হেঁটে টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় ফিরেছিলাম বাড়িতে। একটুও ক্লান্ত হইনি। একটা জোরালো ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মৃণাল সেনের সিনেমার জাম্প কাট এডিটের মতোই ভেসে ভেসে আসছিল তার সিনেমার মিলিত মন্তাজ! আর তার মধ্যে মিলে যাচ্ছিল কালার ছবি অর্থাৎ আমার নিজের ‘চোখ’ ক্যামেরায় দেখা আজকের ওঁকে আর ওঁর কথাগুলো! আর আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম মৃণাল সেনের এলডোরাডো— কলকাতার বুকের ওপর দিয়ে। মনে হয়েছিল টপ শটে আমার দিকে জুম করলে হয়তো ভিড়ের মধ্যে আমাকেও ওঁর ছবির কেন্দ্র চরিত্র মনে হবে। পথে শপিং মলে ম্যানিকুইন দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। পাছে ফুটপাথের ধারে পড়ে থাকা ইঁটের টুকরোটা হাতে তুলে ফেলি! রাস্তার ধারে সর্বহারা বিরাট পরিবার দেখে মনে হচ্ছিল যেন ‘পরশুরাম’ কই এদের মধ্যে? বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবতীকে দেখে মনে হয়েছিল সে যেন আজকে রাতে বাড়ি ফেরে নির্বিঘ্নে। নাহলে তার বাড়ির চৌকাঠের ভেতর মত, বিরোধ আর দ্বন্দ্ব নিয়েই শুরু হবে আরেক গল্প। আসলে এমনই তাঁর কাজের প্রভাব যে মননে গেঁথে থাকে, থাকবেও— হাজার বছর ধরে দেখা মানুষের এই চিরাচরিত ইতিহাস। লাঞ্ছনার ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস। যার কোনো বদল ঘটেনি। ঘটবেও না।
এরপর কতবার গেছি ওঁর কাছে। আমার বানানো ছোটো ছবিও ওঁকে দেখিয়েছি। উনি দেখেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন। অনেক কথা বলেছেন। ততদিনে সুরমা ঘটক (ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী)-এর প্রায় নাতি হয়ে উঠেছিলাম। তাই উনিও আমায় একটা কাজে মৃণাল সেনের কাছে পাঠিয়েছিলেন, গেছি। গীতা সেনও গল্প করেছেন। অনেকদিন ওদের স্নেহ পেয়েছি। একবারই কুণাল সেন মহাশয়ের কাছে অনুরোধ করে একটা ছবি তুলেছিলাম এরকমই এক জন্মদিনে। সে বছরই ডিসেম্বর মাসে চলে গেলেন মৃণাল সেন। শেষ যাত্রায় ইচ্ছে করেই যাইনি। কারণ ইচ্ছে করেনি। চোখ বন্ধ করে শুধু ভেবে গেছি এই মানুষটি আমার হাত ধরেছেন দু হাত দিয়ে। পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করেছি তাঁকে কিন্তু মনে পড়েছে ২০১৩-র সেই ১৪ মে সন্ধেবেলা হেঁটে বাড়ি ফেরাটা। কারণ সেদিন যেমন আক্ষরিক ও রূপক দু-অর্থেই নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরও ঠিক তেমনটাই মনে হয়েছিল। এ লেখা শেষ করেও চোখ বন্ধ করে বসে থাকব কিছুক্ষণ। মনে করব যাঁদের স্নেহ পেয়েছি অল্প হলেও, যাঁদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম বলে আজ কিঞ্চিৎ গর্ববোধ করি, তাদের স্মরণ করে যেন কর্মেও শিরদাঁড়া সোজা রেখে প্রতিফলন করতে পারি তাঁদের দেখানো সেই সৎসাহস।
সেই সাহসই নতুন করে বার্ষিক নিয়মে ঝালিয়ে নেওয়ার অন্যতম দিন এই ১৪ মে।
Powered by Froala Editor