ডিয়েগো ভেলাসকেজ নামক একজন চিত্রকর ছিলেন। ১৫৯৯ সালে স্পেনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জীবদ্দশায় বেশ কিছু অনবদ্য ছবি তিনি এঁকেছিলেন। যার মধ্যে কিছু ছবি আজও পেইন্টিং-এর ইতিহাস পড়ানোর সময় ছাত্রছাত্রীদের দেখানো হয় এবং ব্যাখ্যা করা হয়। যে কোনো শিল্প চর্চার ক্ষেত্রেই সেই শিল্পের ইতিহাস চর্চা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার ধারণা একমাত্র বাঙালিরা ছাড়া পৃথিবীর সমস্ত জাতিই এটা গুরুত্ব সহকারে করে থাকে। বাঙালি করে না এবং সিনেমা শিল্প নিয়ে তো একেবারেই করে না। এটায় পরে আসছি। তার আগে সিনেমা সংক্রান্ত এই লেখায় ভেলাসকেজ মহাশয় কেন এবং কীভাবে এলেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করি। সেটা করতে গেলে একজন প্রখ্যাত চিত্র পরিচালকের নাম বলতে হবে। কারণ তার মাধ্যমেই ভেলাসকেজ সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছিলাম। পরিচালকের নাম জ্যঁ লুক গোদার। ওঁর সম্পর্কে অনেকেই জানেন। কিন্তু যারা জানেন না অথচ ‘বুলবুল’ ছবিটা দেখেছেন এবং বক্তব্য রেখেছেন, তাঁদের জন্য ছোটো করে কিছু বলি। উনি একজন ফরাসি চলচ্চিত্রকার। ১৯৬০ সালে ‘ব্রেথলেস’ নামক একটি ছবি বানিয়ে পরিচালনার জগতে আসেন। ছবিটির জন্য সেবার তিনি বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত পুরস্কার তিনি পেয়েছেন এবং পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে গোটা চলচ্চিত্র জগত তাকে মেনেও নিয়েছে। তা এহেন গোদার ১৯৬৫ সালে ‘পিয়েরো লে ফু’ নামক একটি ছবি বানিয়েছিলেন যাতে তিনি ভেলাসকুজের নাম উল্লেখ করেছিলেন। টাইটেল দৃশ্যের একদম শেষে যেখানে ছবির নাম দেখানো হয় সেখানে ছবির প্রোটাগনিস্টের কণ্ঠে ভেলাসকুজের নাম আমরা শুনতে পাই।
তারপরে দেখা যায় যে, তিনি আর্ট ক্রিটিসিজম গোছের একটা বই পড়ছেন যেখানে ভেলাসকেজ সম্পর্কে একটা লম্বা ডেসক্রিপশন আছে। শুধু নাম আর পরিচয় দিয়েই গোদার ক্ষান্ত থাকেননি। ছবিতে ভদ্রলোকের ১৬৫৬ সালে আঁকা ‘লাস মেনিনাস’ ও ‘ইনফান্টা মার্গারেটা টেরেসা ইন অ্যা পিঙ্ক ড্রেস’ নামক পেইন্টিং দুটিকে তিনি সিনেম্যাটিক্যালি অ্যাডাপ্ট করেছিলেন। অর্থাৎ পেইন্টিং-এর রঙ, তার দর্শন, তার ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য গুলিকে হৃদয়ঙ্গম করে গোদার তার চলচ্চিত্রের কিছু সিলেক্টিভ দৃশ্যপটকে সেরকম ভাবে সাজিয়েছিলেন। যাকে আমরা ট্রিবিউট দেওয়াও বলতে পারি।
আরও পড়ুন
ভারত-চিন যুদ্ধ, সেন্সর বোর্ডের কোপে মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’
আরও পড়ুন
শিল্পের পাশাপাশি, অস্বস্তিতে পড়ার জন্যেও ‘পার্সেল’ দেখা প্রয়োজন আমাদের
এই একই জিনিস আরেকজন পরিচালক তার একটি ছবিতে করেছিলেন। সেই ছবিটা হয়ত খুব বেশি লোক দেখেননি, কিন্তু পরিচালককে আমরা খুব ভাল করে চিনি এবং তার অন্যান্য কিছু ছবি আমরা দেখেছি। পরিচালকের নাম সত্যজিৎ রায়। ছবিটার নাম ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি(১৯৭৭)’। এখানে সত্যজিৎ ভেলাসকুজের ‘লাস মেনিনাস’-র সঙ্গে ‘পোট্রেট অফ ইনোসেন্ট এক্স’ ও অন্যান্য কিছু পেইন্টিং-এর কালারস্কিম ও ভঙ্গিকে ব্যবহার করেছিলেন ছবির কিছু কিছু দৃশ্যপট নির্মাণে।
আরও পড়ুন
নেট প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন প্রোডিউসাররা; সিনেমাহলের ভবিষ্যৎ ও কিছু প্রশ্ন
আরও পড়ুন
অস্কারের জন্য মনোনীত প্রথম পাকিস্তানি সিনেমা, কাহিনিকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
এছাড়া আরেকজন পরিচালক তার আরেকটি ছবিতে এই একই জিনিস করেছিলেন। পরিচালকের নাম ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা। ছবির নাম ‘ড্রাকুলা (১৯৯২)। কপোলা হলেন সেই মানুষ যিনি ‘গডফাদার’ ট্রিলজির ছবিগুলি বানিয়েছিলেন। যাঁর থেকে বিভিন্ন ভাবে প্রেরণা পেয়ে ও টুকে পৃথিবীর প্রায় যাবতীয় গ্যাংস্টার ছবিগুলি তৈরি হয়েছিল, হয়ে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
এবার কথা হল, তারা করেছিলেনটা কী! চলচ্চিত্রগুলি থেকে কিছু স্টিল ছবি দিলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমে ‘পিয়েরো লে ফু’। তারপর ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’। এবং শেষে ‘ড্রাকুলা’।
ছবিগুলি বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা। ফলে অরিজিনাল রং হয়তো পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু প্রতিটি ছবির দৃশ্যপটে লাল রং-এর ব্যবহার ও একধরণের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। এবং বোঝা যাচ্ছে যে তার প্রেরণা বা রেফারেন্স এরা প্রত্যেকেই পেয়েছিলেন ভেলাসকুজের পেইন্টিং থকে। রং ছাড়াও কম্পজিশনেও বিভিন্ন মিল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কেন? ভেলাসকেজ ছিলেন স্প্যানিশ রাজসভার একজন চিত্রকর। রাজ পরিবারের বিলাস, বৈভব, শৌর্য, বীর্য, ঐশ্বর্য ইত্যাদির প্রোপ্যাগান্ডা ছবি আঁকাই ছিল তাঁর কাজ। কিন্তু তিনি সেই সময়ের স্প্যানিশ রাজ পরিবারের মধ্যে একধরণের অবক্ষয় ও মহিলাদের জীবনে একধরণের বিষণ্ণতা ও বোরডম অনুভব করেছিলেন। কিন্তু সেটা আঁকার অনুমতি তার একেবারেই ছিল না। সেটা গর্হিত অপরাধ। ফলে তেল রঙে ছবি আঁকার এই নতুন ধরণের আঙ্গিক তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যাতে লাল রঙের আধিক্য থাকবে। এবং ছবিগুলি সাদা চোখে দেখলে ‘রয়েল রেড’ মনে হলেও একটা বিশেষ অবস্থান থেকে গভীর ভাবে দেখলে লাল রঙের মধ্যে সেই বিষণ্ণতা আর অবক্ষয়ের সুর ধরা পড়বে। একধরণের করুণ রসের সঞ্চার হবে। শিল্পের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত সত্যনিষ্ঠ হওয়া। সেই পথে বিভিন্ন বাধা আসে, কিন্তু মগজাস্ত্রের সাহায্যে শিল্পীরা সেই বাধা অতিক্রম করেন। ভেলাসকেজ এভাবেই করেছিলেন।
গোদার ‘পিয়েরো লে ফু’ ছবিতে এই একই জিনিস করেছিলেন। ছবিতে উচ্চবিত্ত ফরাসি জীবনের অবক্ষয়, বিষণ্ণতা ও ধ্বংসকে তুলে ধরার জন্য তিনি ভেলাসকুজের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই লাল রঙের আধিক্য। ছবিতে নায়িকা আনা কারিনার একটা ফ্রেম ভেলাসকুজের ছবির একটি চরিত্র মার্গারেট থেরেসার পোট্রেটকে সরাসরি রেফার করে।
সত্যজিৎ রায় যেহেতু নিজে ছবি আঁকিয়ে ফলে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিতে এই ব্যপারটিকে তিনি কে তিনি আরও শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন। ওখানে ছিল স্প্যানিশ রাজদরবার আর এখানে লখনউর ব্যর্থ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ-এর দরবার। দু যায়গাতেই এক ধরণের বিষণ্ণতা, অবক্ষয় ও ধ্বংসের আবহ বিরাজমান।
ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার ‘ড্রাকুলা’ ছবিতে এই জিনিসগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ‘রক্ত’।
এবার বুলবুলের কিছু ছবি দিই।
‘বুলবুল' অষ্টাদশ শতকের এক বাঙালি জমিদার পরিবারের অবক্ষয়, মহিলাদের বিষণ্ণতা আর রক্তপাতের গল্প। সেজন্যই দৃশ্যপটে লাল রঙের এই আধিক্য। যেটা একধরণের করুণ রসের সঞ্চার করছে। আর এভাবেই ‘ড্রাকুলা’, ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ আর ‘পিয়েরো লে ফু ’-র হাত ধরে ভেলাসকুজের সঙ্গে করমর্দনে লিপ্ত হয়ে যায় ‘বুলবুল’। আরেকবার শিল্পের হাত ধরে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য।
ইংরাজিতে ‘ব্লাড মুন’ বলে একটা বিষয় আছে। বহু বছর পর পর এক বিশেষ ধরণের চন্দ্রগ্রহণ হয় যাতে চাঁদের রং হয়ে যায় লাল। বুলবুলের পোস্টারের উৎপত্তি সেখান থেকেই।
বিভিন্ন ধর্মে এই ‘ব্লাড মুন নাইটের’ বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। যার মোদ্দা কথা হল এই সময় অশুভ শক্তিরা জেগে ওঠে। পাশ্চাত্যের ড্রাকুলা আর প্রাচ্যের 'চূড়েল'। আর শুধু জেগেই ওঠে না, প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং হত্যালীলা চালায়। 'বুলবুল'-এ এটাও আছে। শুভ শক্তি আর অশুভ শক্তি নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব আছে। নতুন ভাবে অশুভ কে দেখার একটা প্রয়াস আছে। “ও চূড়েল নেহি হ্যায়, দেবী হ্যায়’।
‘বুলবুল’এর দৃশ্যপটে লাল রং-এর ব্যবহার ও আধিক্য সম্পর্কে কথা বলতে গেলে এইভাবেই ইতিহাসের মধ্য দিয়ে তার উৎসে পৌছতে হবে। আগেই বলেছি যেটা বাঙালিরা করে না। ফলে ফেসবুকে আনতাবড়ি কিছু কথা লিখে দিলে কীভাবে হবে? কারণ সিনেমায় কোনোকিছু আনতাবড়ি হয় না। তার পেছনে অনেক বিনিদ্র রজনীর ভাবনাচিন্তা থাকে। তাতে ঠিক ভুল থাকতেই পারে। কীসে না আছে? কিন্তু ছিদ্রান্বেষণের মাধ্যমে নিজেদের ইগো স্যাটিসফাইড করে চিরকাল ধরে এক শ্রেণীর বাঙালি শিল্প-রস আহরণ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে এসেছে। তাদের জন্য খারাপ লাগে।
আমরা ভুলে যাই, চলচ্চিত্রর উৎপত্তি হয়েছিল মূলত দৃশ্য মাধ্যম হিসেবে। পরে তার সঙ্গে শব্দ যুক্ত হয়েছিল। শব্দ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারপরেও ছবি মূলত দেখার জিনিস। ছবির দৃশ্যপট হল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ‘বুলবুল’ ছবিটি বিভিন্ন দিক থেকে ইন্টারেস্টিং। সেগুলো নিয়ে অন্য কোনো সময় কথা বলব। কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল ছবির দৃশ্যপট ও কালার স্কিম। তাস খেলায় রঙের গোলামের মতো। এবং তার পেছনে এক গভীর চিন্তাভাবনা আছে। আর আছে দৃশ্য মাধ্যমকে ঐতিহাসিক ভাবে দেখার এই প্রচেষ্টা। ওপরে যে তিনজন পরিচালকের নাম বলেছি, তাঁরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পরিচালক। এঁদের সঙ্গে ‘বুলবুলে'র পরিচালক অন্বিতা দত্ত কোনো তুলনাতেই আসেন না। কিন্তু এটা মাথায় রাখতে হবে যে, খুব বেশি পরিচালক এতটা ভাবেন না।
সিনেমা এত সহজ বিষয় নয়। সিনেমা শুধু গল্প বলে না। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’, ‘মণিহারা’, ‘চোখের বালি’ আর তার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের কিছু ছবি ইত্যাদির সঙ্গে ‘বুলবুল’-এর গল্পের মিল খুঁজে সময় নষ্ট আর নিজেদের ইগো স্যাটিসফাই না করে সিনেমা শিল্পের বহু স্বর, বহু স্তর, বহু শিল্পের সমন্বয় ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করলে দর্শক ও সমালোচক হিসেবে বাঙালির উন্নতি হতে পারে আসা করি। মিল তো আছে। আপনারা সেটা খুঁজেও পেয়েছেন। কিন্তু তাতে কি দোষ হয়েছে বলুন তো? এটা তো একধরণের ওপর ওপর ইতিহাস চর্চা। হতের কাছে মূল টেক্সট আর হার্ডডিস্কে ছবি গুলো থাকলে সহজেই গল্পের সঙ্গে গল্প মিলিয়ে দেওয়া যায়। এটা সিনেমার আসল জিনিস নয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তো গোদার, সত্যজিৎ, কপোলা এঁদের ছবির মধ্যেও মিল আছে। ছবিতে কি দেখাচ্ছের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল কীভাবে দেখাচ্ছে। ভঙ্গি বা আঙ্গিকটা কী? তবে এটাও আসল জিনিস নয়। আসল হল ছবিটা দেখে কি অনুভূতি হচ্ছে। বিভিন্ন জিনিসের সমন্বয়ে তৈরি ‘বুলবুল’ দিনের শেষে কি একটা প্রকৃত ছবি হয়ে উঠতে পারছে? আমার মতে, পেরেছে। মাখনের ওপর ছুড়ি যেভাবে চলে ‘বুলবুল’ আমার কলিজা দিয়ে সেভাবে চলে গেছে। রক্ত হিম হয়ে গেছে। ভয়টা ভূতের নয়। অন্যকিছুর। সেসব কথা না হয় আরেকদিন বলব।
Powered by Froala Editor