‘নগ্ন অক্ষরের গায়ে’ শঙ্খস্পর্শ, সাক্ষী শিশির মঞ্চ

“কিংবদন্তির মৃত্যুর পর হয়তো স্মৃতিচারণাই মুখ্য হয়ে ওঠে কিছুদিনের জন্য। কিন্তু সেইসব ব্যক্তিগত স্মৃতিকে কিছুটা সরিয়ে রেখে তাঁর কাজের ব্যাপ্তির কাছে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। দায়িত্বও বটে।” বলছিলেন সম্পাদক অম্লান দত্ত। কবি-প্রাবন্ধিক-সমালোচক শঙ্খ ঘোষের (Shankha Ghosh) মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে এক বছরেরও বেশি সময়। আর এই সময়পর্ব জুড়ে তেমনই এক চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তিনি। সেই চেষ্টার ভিতর দিয়েই আত্মপ্রকাশ করল ছোট্ট একটি বই। ‘নগ্ন অক্ষরের গায়ে’ (Nagna Aksharer Gaaye)।

“…এপিটাফগুলি তার অভিধা বাড়ায় সন্ধ্যাবেলা
নগ্ন অক্ষরের গায়ে মৃত বন্ধুদের হিম শ্বাসে।”

এই পঙক্তিগুলি লেখার পর কেটে গিয়েছে চারটি দশক। কবি নিজেও এখন তাঁর সেই সব বন্ধুদের ভিড়ে মিশে গিয়েছেন। অক্ষর তো আজন্ম নগ্নই হয়। সেইসব অক্ষরের গায়ে আজ এসে লাগে শঙ্খ ঘোষের শীতল শ্বাস। বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে অম্লান বলছিলেন, “আমরা যাঁরা তাঁকে কিছুটা কাছ থেকে দেখেছি, তাঁদের বাচনে, জীবনে শঙ্খবাবু মিশে গিয়েছেন। আমরা সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারব না আর কোনোদিনই। হয়তো চাইবও না।” এভাবেই সাহিত্যের পরম্পরা গড়ে ওঠে। অর্থহীন নগ্ন অক্ষরমালা ক্রমশ নিজেদের পৃথক পৃথক অর্থ খুঁজে নিতে থাকে।

গতকাল শিশির মঞ্চে বইটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করলেন সৌরীন ভট্টাচার্য। শঙ্খবাবুর প্রায় সমকালীন এই মানুষটির স্মৃতির ভাণ্ডার যে নানা মণি-মানিক্যে ভরা – সে-কথা আন্দাজ করা কঠিন নয়। কিন্তু তবু সেইসব স্মৃতিকথা থেকে যেন ইচ্ছে করেই কিছুটা পিছনে হাঁটলেন তিনি। বরং বললেন, “আমাদের অভিজ্ঞতার ভার যেন আগামীদিনের পাঠকদের প্রভাবিত না করে। তাঁরা শঙ্খ ঘোষকে খুঁজে নিক নিজেদের মতো করেই।”

আরও পড়ুন
জার্মান ভাষায় রবীন্দ্র-কবিতা, পাঠোদ্ধারে সহায় শঙ্খ ঘোষ

এই যে সৃষ্টির নিজস্ব আভরণে বেঁচে থাকা, এখানেই তো আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা হয়ে যান শিল্পীরা। বই প্রকাশের পর সামাজিক মাধ্যমে অম্লান দত্তও সেই কথারই সঙ্গত করেছেন। কালো মলাটে শিল্পী দেবব্রত ঘোষের অক্ষরশিল্পে লেখা শঙ্খবাবুরই তিনটি শব্দ, ‘নগ্ন অক্ষরের গায়ে’ এবং তার নিচে শঙ্খ ঘোষের মুখের প্রতিকৃতি, এটুকুই এই বইয়ের প্রচ্ছদ। অন্তত এটুকুই চেয়েছিলেন সম্পাদক নিজে। বইয়ের নামের নিচে সম্পাদক হিসাবে তাঁর নিজের নামটা বাহুল্য মনে হয়েছে তাঁর।

আরও পড়ুন
বাংলা সাহিত্যজগতে নক্ষত্রপতন, প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ

তবে ব্যক্তিজীবন ব্যতিরেকেও তো শিল্পী জীবন সম্পূর্ণ রূপ পেতে পারে না। সেই সূত্রেই আবার বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান ফিরে ফিরে গিয়েছে স্মৃতির দরবারেও। অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে দেখতে চাওয়া হয়েছে এক অন্য শঙ্খ ঘোষকে। যাঁর পরিচয় হয়তো কেউ কেউ জানেন, সকলে জানেন না। ‘প্যাপিরাস’ প্রকাশনার কর্ণধার অরিজিৎ কুমার বলছিলেন এমনই নানা ঘটনার কথা। কখনও তাঁর মিতভাষী অথচ ঋজু ভাবনাচিন্তার কথা, আবার কখনও অতিথি বাৎসল্যের কথা। ব্যস্ততার মধ্যেও যিনি কখনও অতিথিকে ফিরিয়ে দিতে পারতেন না। আবার শঙ্খ ঘোষকে তিনি দেখেছেন, খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে ফোনে একটি প্রবন্ধ শুনে সেই প্রবন্ধ সংশোধন করে দিতে। খাওয়া ফেলে তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলতে বলতেই বই ঘেঁটে চলেছেন তিনি। পাণ্ডিত্যের সঙ্গে মগ্নতার এমন মেলবন্ধন শঙ্খ বাবুই পারতেন।

আরও পড়ুন
ভারতের ইতিহাসে দীর্ঘতম কারাবন্দি কবি তিনি, মুক্তির দাবিতে সই শঙ্খ ঘোষের

তেমনই আবার শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়, সুকান্ত চৌধুরী বলছিলেন এক অল্প চেনা শঙ্খ ঘোষের কথা। তিনি শুধু কবি বা প্রাবন্ধিক তো নন। তার পাশাপাশি নাটক নিয়েও তাঁর ভাবনার পরিধি বিস্তারিত। তবে মূল ধারার নাটকের মঞ্চ থেকে সরে তিনি কখনও চলে গিয়েছেন ছোটদের নাটকের জগতে। কখনও আবার দৃষ্টিহীন মানুষদের নিয়ে বেঁধেছেন নাটকের দল ‘অন্য দেশ’। অমিয় দেব, বিশ্বজিৎ রায় বলছিলেন এই বহুমাত্রিক মানুষকে ক্রমশ ছড়িয়ে দেওয়ার কথা। সেই কাজও যে আমাদের সকলের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

স্মৃতির পিছল গলিতে ঘুরতে ঘুরতে এই অনুষ্ঠান বারবার থমকে থেমেছে গানের কাছে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে। ‘পুনশ্চ’ শিল্পীগোষ্ঠীর পাশাপাশি সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন সুমা মুখোপাধ্যায় সাহা এবং কৃষ্ণেন্দু সেনগুপ্ত। অম্লান বলছিলেন, “শঙ্খবাবুর পছন্দের গানগুলি থেকেই কিছু গান বেছে নিয়েছিলাম আমরা।” আর এইসমস্ত গানের ভিতর দিয়েও তো ছুঁয়ে দেখা যায় শঙ্খবাবুর চিন্তার জগতকেই। অম্লানের কথায়, “শুধুমাত্র পুঁথিগত চর্চার মধ্যে শঙ্খ ঘোষকে আটকে রাখলে হবে না। তিনি নিজে সাহিত্যকে দেখতেন জীবনের মধ্যে। আমাদেরও তাঁর সাহিত্যকে এবং সাহিত্যভাবনাকে জীবনের অংশ করে তুলতে হবে।”

বিচ্ছেদ তো চিরন্তন সত্য। তবু সব বিচ্ছেদ শুধু শূন্যতাতেই শেষ হয় না। কিছু কিছু বিচ্ছেদ শেষে দেখা যায় প্রাপ্তির ভাণ্ডার পূর্ণ হয়ে উঠেছে। শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিচারণার অনুষ্ঠানের শেষেও তাই রেশ রেখে গেল – ‘আনন্দ গান উঠুক তবে বাজি…’। শিশির মঞ্চের দর্শকদের শরীরেও কি তখন এসে লাগছিল না শঙ্খ ঘোষের ‘হিম শ্বাস’?

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More