বিশ্বের প্রাচীনতম সাহিত্য ঋগ্বেদে রয়েছে রাত্রির মহিমা—'রাত্রিসূক্ত'। এই রাত্রিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধীমান ব্যাখ্যাকার দেখেছেন বিচিত্র দৃষ্টিতে। রাত্রি কখনও বিশ্ব-ধ্বংসের পর অবশিষ্ট অপার শূন্যতা, কখনও মানব-মনের পুঞ্জীভূত অন্ধকার। আবার এই রাত্রিই ভক্তের চিত্তে শৃঙ্গাররসঘন আনন্দপূর্ণিমা।
ঋগ্বেদের ঋষি বলছেন—
ওর্বপ্রা অমর্ত্যা নিবতো দেব্যুদ্ধত:। জ্যোতিষা বাধতে তম:।।
"বিশাল হয়ে ছাইলেন অমর্ত্যা (সেই) দেবী, যা-কিছু আছে গভীরে, আছে উজানে। জ্যোতি দিয়ে হটিয়ে দিচ্ছেন আঁধার।" (শ্রীঅনির্বাণকৃত অনুবাদ, ঋকবেদ, ১০.১২৭.২)
আরও পড়ুন
গোপীনাথ কবিরাজের চেতনায় কীভাবে ধরা দিয়েছেন রহস্যময়ী কালী?
বৈদিক ঋষি দর্শন করছেন রাত্রিসূক্ত, গাইছেন রাত্রির মহিমা। কর্মপর ভাষ্যকার আচার্য সায়ণ ব্যাখ্যা করছেন—
আরও পড়ুন
‘তু সবকা খুদা, হে কৃষ্ণ কানহাইয়া, নন্দ লালা, আল্লাহ্ গণি, আল্লাহ্ গণি’
“হে রাত্রি, তুমি 'অমর্ত্যা'— মরণরহিতা, তুমি 'দেবী'— ক্রীড়াময়ী। 'উরু'— বিস্তীর্ণ অন্তরীক্ষকে তুমি 'আ অপ্রা'—প্রথমে পূর্ণ করেছ অন্ধকার দিয়ে। 'নিবত:' এবং 'উদ্ধত:'—নিম্নের লতাগুল্ম আর ঊর্ধ্বের বৃক্ষাদিকে তুমি স্বকীয় তেজে আবৃত করেছ। তারপর, সেই 'তম:' অর্থাৎ অন্ধকারকে তুমি 'জ্যোতিষা' গ্রহনক্ষত্রাদিরূপ তেজ:পুঞ্জ দ্বারা 'বাধতে' পীড়িত করেছ, পরাভূত করেছ।”
ভারতবর্ষীয় ঋষিমানব যে রাত্রিকে প্রত্যক্ষ করেন, তার স্থিতি সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় অবধি। আবার, মেরুনিবাসী দেবসমাজের রাত্রিকাল ছয়মাসব্যাপী, মানবের ভাষায় তাকে বলে দক্ষিণায়ন। প্রতি বছর, সেই রাত্রির অন্ত্যভাগে কার্তিক মাসের অমাবস্যায় কালীর আরাধনা, অতঃপর পরবর্তী শুক্লা একাদশীতে শ্রীবিষ্ণুর উত্থান, নারায়ণের সাংবাৎসরিক নিদ্রাভঙ্গ। গণপতি মুনির মতে, এই বৈদিক রাত্রিই তন্ত্রে আদ্যা মহাবিদ্যা দক্ষিণাকালিকা।
আবার, ধ্রুব নক্ষত্রেরও পারে অপার্থিব সত্যলোকে ব্রহ্মার রাত্রি বহু কোটি বর্ষব্যাপিনী। এর অধিক ব্যাপ্তিময়ী রাত্রি ব্রহ্মাণ্ডে আর নেই। একে বলে 'কালরাত্রি', 'ব্রহ্মরাত্রি' বা 'কল্পান্তরাত্রি'। এই রাত্রিতে ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত লোকাবলী ধ্বংস হওয়ার পর নারায়ণের গর্ভে অনন্তকোটি জীবাত্মা সূক্ষ্ণভাবে বিরাজ করে, পরবর্তী কল্পের অপেক্ষায়। সেই রাত্রির শেষে, ব্রহ্মার প্রার্থনায় উদ্বোধিতা যোগনিদ্রারূপিণী মহাকালী বিষ্ণুর দিব্যতনু থেকে নির্গতা হন, নারায়ণের নিদ্রাভঙ্গ ঘটে। ব্রহ্মার এই প্রার্থনাকে তাই তন্ত্রবিদ্ বলেছেন, 'তান্ত্রিক রাত্রিসূক্ত'।
যোগনিদ্রা মহাকালী রাত্রিরূপিণী। ব্রহ্মার স্তব অনুসারে তিনি 'কালরাত্রি'—যে রাত্রে জগৎ লয় হয়, আবার তিনিই 'মহারাত্রি'—যে রাত্রে ব্রহ্মার বিলয় ঘটে, মোক্ষলাভ ঘটে। তিনিই আবার 'মোহরাত্রিশ্চ দারুণা'—জীবগণের অন্তরে পুঞ্জীভূত মায়াজনিত অন্ধকার, অজ্ঞানতামস। এই মোহরাত্রির অবসানে জীবের ব্রহ্মজ্ঞান লাভের প্রারম্ভ, অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ। যিনি অন্ধকারময়ী মহামায়া, তিনিই আবার আলোকময়ী যোগমায়া— ‘জ্যোতিষা বাধতে তমঃ’।
শ্রীচৈতন্য বলেছিলেন, ‘বেদের প্রতিজ্ঞা কেবল কহয়ে কৃষ্ণকে’—সমস্ত বেদের তাৎপর্য শ্রীকৃষ্ণের মহিমাগান। এই বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পড়া যায় বৈষ্ণব পণ্ডিত নীলকণ্ঠ সূরীর 'মন্ত্রভাগবতম্' বইটিকে। এই বইতে নীলকণ্ঠ ঋগ্বেদের বিভিন্ন মন্ত্রের কৃষ্ণপরক ব্যাখ্যা করেছেন—বেদের পাতায় পাতায় খুঁজে পেয়েছেন ভাগবতী কৃষ্ণলীলা। তিনি যখন বেদমন্ত্রে রাসলীলার সন্ধান করলেন, কী আশ্চর্য, তুলে নিয়ে এলেন রাত্রিসূক্তের এই মন্ত্রটি। কেন? রাসরজনীর বিশেষত্ব তাহলে একটু বুঝে নিতে হবে।
শ্রীমদ্ভাগবতের রাসপঞ্চাধ্যায়ের একেবারে শুরুতে রাসরজনীকে বলা হচ্ছে ‘তা রাত্রিঃ’— এক রাত্রির মধ্যে বহু রাত্রির সমাহার, তাই বহুবচন। আবার শেষ অধ্যায়ের অন্ত্যভাগে শুকদেব গোস্বামী বলেছেন ‘ব্রহ্মরাত্রে উপাবৃতে’— এই বিশেষ রাত্রিটি হলো 'ব্রহ্মরাত্রি'। এই দুই বক্তব্য মিলিয়ে সারার্থদর্শিনী টীকায় বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর সিদ্ধান্ত—শ্রীভগবানের মনে যে সুদীর্ঘ নৃত্য-গীত-বিলাসাদির ইচ্ছা ছিল, তা পূরণ করার জন্য সেই একটি রাত্রির মধ্যে শতকোটি রাত্রিকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের নিত্যসহচরী যোগমায়া। চার-প্রহর-পরিমাণ সেই রাত্রির মধ্যেই প্রবেশ করেছিল একটি 'ব্রহ্মরাত্রি'— অর্থাৎ ব্রহ্মার সহস্র-চতুর্যুগ-ব্যাপিনী কালরাত্রি। যোগমায়া অঘটন-ঘটন-পটীয়সী কালসঙ্কর্ষিণী— স্বকীয় স্তম্ভিনী শক্তির সাহায্যে সময়চক্রের গতিরোধ করে এমন অচিন্তনীয় ব্যাপার ঘটানো তাঁর পক্ষে সহজ লীলাবিলাস মাত্র। যে কৃষ্ণের শিশুশরীরের অভ্যন্তরে অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, তাঁর পক্ষে এমন খেলা তো মোটেই আশ্চর্য নয়!
তাই, রাত্রিসূক্তের ওই মন্ত্রটি নীলকণ্ঠ সূরীর মতে রাসরজনীর বিবরণ। নীলকণ্ঠকৃত ব্যাখ্যায় ঋষিকবির বক্তব্য— হে রাত্রি, তুমি 'দেবী'— তুমি লীলাময়ী, তুমি 'অমর্ত্যা'— তুমি অমানুষী। তুমিই অন্তরীক্ষ— যে আকাশে দেখা যায় ইন্দ্র, বায়ু আদি দেবতার দল। তুমি 'নিবতঃ' এবং 'উদ্ধতঃ'— অর্থাৎ নীচে ভূলোকে রাসমণ্ডলে অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধাদি গোপীগণ, এবং ঊর্ধ্বে রাসলীলা দর্শনে আগত বিমানচারী দেবতা-গন্ধর্বের দল— উভয়কেই জানো 'অপ্রাঃ'। কারণ তুমিই 'জ্যোতিষা বাধতে তমঃ'— শারদ চন্দ্রকিরণের দ্বারা দূর করে দিচ্ছ অন্ধকার। হে জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি, তিন ভুবনকে তুমি আনন্দে ভরিয়ে দিচ্ছ।
রাত্রি, তুমি আনন্দময়ী।
Powered by Froala Editor