বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে, এখন অগ্রহায়ণ মাস চলছে। রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করছেন কালপুরুষ। সেই ছোট্টবেলা থেকে তিনি আমাদের ভীষণ চেনা। আজ, কালপুরুষের গল্প বলা যাক।
আগে বলি অগ্রহায়ণ মাসের কথা। অনেক অনেক আগে, এই মাস থেকে বৎসর-গণনা শুরু হত, তাই এর নাম অগ্রহায়ণ। এই মাসের আরেকটি নাম হচ্ছে 'মার্গশীর্ষ'। ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, মার্গশীর্ষ মাস বছরের সেরা মাস, এ মাস শ্রীভগবানের বিভূতি। এর অনুরণন শোনা যায় মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে, ফুল্লরার বারোমাস্যায়—"মাসমধ্যে মাইসর আপনে ভগবান।" সে তো বোঝা গেল, কিন্তু এই নামটির অর্থ কী? অর্থ খুব সোজা, বছরের অন্যান্য মাসগুলির নাম যেমন আকাশের নক্ষত্রের নামে, এই যেমন—বিশাখা থেকে বৈশাখ, কিংবা কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, পুষ্যা থেকে পৌষ—মার্গশীর্ষও ঠিক তাই। 'মৃগশিরা' নক্ষত্রের সঙ্গে জড়িয়ে এ মাসের নাম 'মার্গশীর্ষ'!
ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে বলে, এই যে মৃগশিরা নক্ষত্র, ইনি স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা। আর এঁকে যিনি আকাশপথে তাড়া করেছেন, তিনি ধনুর্বাণধারী কালপুরুষ— তিনি সাক্ষাৎ রুদ্র, অর্থাৎ শিব। কিন্তু শিব হঠাৎ ব্রহ্মার ওপর এমন রুষ্ট হলেন কেন? সেই কাহিনির সন্ধান মিলবে ঋগ্বেদের ঐতরেয় ব্রাহ্মণে। আসুন, কাহিনিটি ফিরে পড়ি।
ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে, একদা প্রজাপতি নিজের দুহিতা অর্থাৎ কন্যার প্রতি কামাসক্ত হয়ে তাঁকে সম্ভোগ করতে চাইলেন। কন্যাটির নাম দিবা, কেউ কেউ তাঁকে ঊষা নামেও ডাকে। কন্যা তখন এই অপবিত্র ঘটনা থেকে রক্ষা পাবার জন্য 'রোহিতা' অর্থাৎ রক্তাভবর্ণা মৃগীর রূপ ধরে ছুটে পালালেন, কিন্তু তাতে কাজ হল না। প্রজাপতিও 'ঋশ্য' অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণ মৃগের রূপ ধরে তাঁর দিকে ধেয়ে গেলেন।
আরও পড়ুন
২১০০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল বিশ্বের প্রথম নক্ষত্র-মানচিত্র
এই দৃশ্য দেখে দেবতারা ভাবলেন— প্রজাপতি এ কী করছেন? এমন পাপ কাজ যে এর আগে কেউ কখনও করেনি! দেবতারা ক্রুদ্ধ হয়ে ভূতমান্ রুদ্রকে (পুরাণে ইনিই ভূতনাথ শিব) বললেন, প্রজাপতিকে দণ্ড দাও! রুদ্র বর চাইলেন, তিনি হতে চাইলেন পশুদের অধিপতি। দেবতারা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করলেন, রুদ্র হলেন পশুমান্ (পুরাণে শিবের নামান্তর পশুপতি)। তখন তিনি প্রজাপতিকে শাস্তি দেবার জন্য ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে তাঁকে তাড়া করলেন। ভীত প্রজাপতি পালিয়ে গেলেন আকাশে।
আরও পড়ুন
নিউটনের সূত্র অগ্রাহ্য করেই জন্ম নিচ্ছে নক্ষত্র, চাঞ্চল্যকর তথ্য সাম্প্রতিক গবেষণায়
এই দৃশ্যই আমরা অগ্রহায়ণ মাসে রাতের আকাশে দেখতে পাই। আকাশে যে 'রোহিণী' নক্ষত্র, সে হল প্রজাপতির সেই মেয়েটি— যে রোহিতবর্ণা মৃগী হয়ে পালাতে চেষ্টা করছিল। তার পিছে রয়েছে 'মৃগশিরা' নক্ষত্র— অর্থাৎ মৃগরূপী প্রজাপতি। আর প্রজাপতিকে ধাওয়া করেছেন ধনুর্বাণধারী 'কালপুরুষ', তিনি স্বয়ং রুদ্র। কালপুরুষের দক্ষিণ হাতে যে তিনটি তারা দিয়ে গড়া তীর— সেটিই বেদের সেই 'ত্রিকাণ্ডা ঈষু'— তিন-পর্বযুক্ত রুদ্রশর! আকাশচারী রুদ্রের সেই তীর-ধরে থাকা হাতটির কাঁধের কাছে যে নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে, সেটির নাম হলো 'আর্দ্রা'। আর, কালপুরুষের পায়ের কাছে রয়েছে তাঁর বিশ্বস্ত শিকারী কুকুর 'লুব্ধক'— রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম তারা। সব মিলিয়ে, একটি চিরন্তন ছবি।
এই কাহিনী বিভিন্ন পুরাণে বারবার পুনরাবৃত, এই ছবি ভারতের বিদগ্ধ মানুষজনের মনের আকাশপটে চিরকালের জন্য আঁকা। এই ছবি মনে করিয়ে দেয়, অনিচ্ছুক নারীর উপর বলাৎকারে উদ্যত ক্ষমতাশালী পুরুষের ক্ষমতার দম্ভ স্থায়ী নয়, সেই অহংকৃত প্রজাপতিরও দণ্ডদাতা আছেন। তিনি রুদ্র, তাঁর দণ্ড ভীষণ। আর তিনি ভীষণ বলেই তিনি শিব, এবং সুন্দর।
Powered by Froala Editor