“নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়ার ২০-২৫ বছর পরে, বা সত্তরের গোড়ার দিকে বিমান মুখোপাধ্যায়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে মানবেন্দ্র কিংবা অন্যান্য শিল্পীরা নজরুলগীতি গাইতে শুরু করেন। এর পর থেকেই নজরুলগীতির সুরবিকৃতি এবং বাণীবিকৃতি ঘটতে থাকে। অনেকের গান নজরুলের নামে, আবার নজরুল লেখা গান অন্য শিল্পীদের নামে প্রকাশিত হয় এই সময়। নজরুলগীতির সঠিক বাণী কিংবা সঠিক সুরের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের।”
বলছিলেন উত্তরপাড়ার (Uttarpara) জীবনস্মৃতি আর্কাইভের কর্ণধার অরিন্দম সাহা সরদার। এবার তাঁর উদ্যোগেই তৈরি হল নজরুলের উপর আস্ত এক সংগ্রহশালা। নজরুল ভাণ্ডার। নজরুলের লেখা গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও চিঠির সংকলন প্রথম তো বটেই, এই সংগ্রহশালায় থাকছে জগৎ ঘটক, নলিনীকান্ত সরকার, নিতাই ঘটক, কমল দাশগুপ্ত, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, সুধীন দাশের মতো স্বরলিপিকারদের ৬০টিরও বেশি স্বরলিপি গ্রন্থের প্রাচীন সংস্করণ। দুই বাংলার নজরুল বিশেষজ্ঞদের লেখা নজরুল-বিষয়ক নানা প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র, পত্র-পত্রিকা, জীবনী ও দুষ্প্রাপ্য নানা ছবিরও সন্ধান মিলবে উত্তরপাড়ার এই সংগ্রহশালায়। শোনা যাবে, ১৪০০-র বেশি নজরুলসঙ্গীতের আদি রেকর্ড। বলতে গেলে এই সংগ্রহশালা এক-কথায় যে-কোনো গবেষক কিংবা নজরুলপ্রেমীর কাছেই একপ্রকার স্বর্গরাজ্য।
জানা গেল, আজ থেকে প্রায় ৮ বছর আগেই এই সংগ্রহশালা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন অরিন্দমবাবু। তাঁর কথায়, “২০১৪ সালে যখন এই গবেষণার কাজ শুরু করি, তখন নজরুলের সমসাময়িক প্রায় সকলেই চলে গিয়েছেন। সে-সময় নজরুল জীবনীকার অরুণকুমার বসু আমাকে বেশ কিছু সূত্র দেন। সেই সূত্র ধরেই দুই বাংলার প্রবীণ নজরুল-গবেষক ও প্রয়াত ব্যক্তিত্বদের পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করি।” এভাবেই একে একে উদ্ধার হয়েছিল বহু দুর্মূল্য প্রাচীন রেকর্ড, চিঠি এবং অন্যান্য নথি। বাংলাদেশ থেকে বহু রেকর্ড ও নথির অনুলিপি করে নিয়ে আসেন অরিন্দমবাবু।
অবশ্য সংগ্রহশালা নয়, অরিন্দমবাবুর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, নজরুলের জীবন ও কাজের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্যচিত্র নির্মাণ। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। বদলে, নজরুলের ওপর আর্কাইভ তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। শুরু হয় নজরুলের বিভিন্ন আকরগ্রন্থের সন্ধান। যে প্রকাশনা সংস্থাগুলি থেকে প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল নজরুলের বিভিন্ন বই, তাঁদের কাছে দ্বারস্থ হন অরিন্দমবাবু। তাছাড়াও কলেজস্ট্রিট বইপাড়ার ফুটপাত থেকেও তিনি সংগ্রহ করেন নজরুলের গ্রন্থের অজস্র প্রাচীন সংস্করণ, পাণ্ডুলিপির অনুলিপি।
এইসব দুর্মূল্য সম্পদকে একত্রিত করেই এবার গড়ে উঠল ‘নজরুল-ভাণ্ডার’। শুধু সংগ্রহই নয়, অরিন্দমবাবুর গবেষণায় উঠে এসেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলসঙ্গীত ও সাহিত্যের বিকার ও বিকৃতির বিষয়টিও। বিগত আট বছরের এই শ্রমসাধ্য গবেষণা এবং সদ্যপ্রতিষ্ঠিত এই সংগ্রহশালাটি তিনি উৎসর্গ করেছেন নজরুলসঙ্গীত গবেষক ও স্বরলিপিকার ব্রহ্মমোহন ঠাকুরকে। “ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের বিভিন্ন লেখার সূত্র ধরেই এক একটা অজানা দরজা খুলে গেছে। বলতে গেলে ওঁর লেখাই আমাকে গাইড করেছে এই গবেষণায়”, জানালেন অরিন্দমবাবু।
আজ, কাজী নজরুল ইসলামের ৪৬তম প্রয়াণ দিবসে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও সমাজ সংস্কারক মীরাতুন নাহারের হাত ধরে উদ্বোধন হল এই ঐতিহাসিক আর্কাইভটির। দরজা খুলে গেল সমস্ত নজরুল অনুরাগী এবং গবেষকদের জন্য। তবে শুধু গ্রন্থাকারে সংরক্ষিত নথিই নয়, দুষ্প্রাপ্য এই তথ্যভাণ্ডারের সংরক্ষণ হয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমেও। ফলে, এক ক্লিকে অনায়াসেই এই নজরুল-জগতে ঘুরে আসতে পারবেন সাহিত্য-অনুরাগীরা…
Powered by Froala Editor