টাইটানিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছোট্ট একটি চাবি! গাফিলতি নাকি অপমানের প্রতিশোধ?

সারা পৃথিবীকে চমকে দিতে ১০৯ বছর আগে সমুদ্রে নেমেছিল টাইটানিক। চমক অবশ্য সত্যিই এল। তবে সে কাহিনি মর্মান্তিক। প্রথম যাত্রাতেই হিমশৈলের আঘাতে ছত্রখান টাইটানিক। আর প্রায় ২ হাজার যাত্রীর মধ্যে প্রাণ হারালেন ১৫২২ জন। এইসব কাহিনি তো সবারই জানা। কিন্তু তারপর? যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের জবানিতেই ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর সেই দুর্ঘটনার টুকরো কিছু ছবি। সেই জাহাজিদের মধ্যেই ছিলেন ফ্রেড ফ্লিট। হাসপাতালে তখন তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। এই অবস্থাতেই তাঁকে জেরা করে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ। বাকিদেরও জেরা করা হয়েছে। তবে ফ্রেড ফ্লিটের জবানবন্দিতে এক অদ্ভুত ঘটনার কথা জানতে পারলেন গোয়েন্দারা। যে হিমশৈলে ধাক্কা মেরেছিল টাইটানিক, খুব কাছে আসার আগে তাকে দেখতেই পাননি কেউ। দেখবেন কী করে? কারোর কাছে বাইনোকুলার ছিল না। জাহাজে বাইনোকুলার নেই? গোয়েন্দাদের অবাক প্রশ্নে ফ্লিট উত্তর দিয়েছিলেন, জাহাজের ক্রো’জ নেস্টে একটি বাইনোকুলার ছিল ঠিকই। তবে তার চাবি ছিল না কারোর কাছেই। জাহাজ ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই নজরে আসে ক্যাপ্টেনের। তবে তখন আর ফেরার পথ ছিল না।

১৫ এপ্রিল, ১৯১২। সেইসময়ের সবচেয়ে বড়ো সমুদ্র জাহাজ টাইটানিক ডুবে গেল সমুদ্রের গর্ভে। আর সেইসঙ্গে অসংখ্য যাত্রীর মৃত্যু। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেকেই নানা দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কেউ দেখিয়েছেন জাহাজের রাডার বেশ ছোটো ছিল। কেউ দেখিয়েছেন জল নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। আবার লাইফবোর্ডের অপ্রতুলতাকেও মৃত্যুমিছিলের জন্য দায়ী করেছেন অনেকে। তবে এসবের পিছনেও বিরাট ভূমিকা পালন করেছে ছোট্ট একটি চাবি। মার্কিন গোয়েন্দারা সেই রহস্যের ইঙ্গিত পেলেও সেই চাবির সন্ধান পাননি। তা পাওয়া যায় আরও বহু বছর বাদে। ১৯৮০ সালে ব্রিটিশ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশানাল সিম্যান’স সোসাইটির কাছে এসে পৌঁছয় টাইটানিক জাহাজের ক্রো’জ নেস্টের চাবি। পাঠিয়েছেন ন্যান্সি ব্লেয়ার।

কে এই ন্যান্সি ব্লেয়ার? তাঁর সঙ্গে টাইটানিকের সম্পর্কই বা কী? খোঁজ নিয়ে জানা যায় তাঁর পিতৃপরিচয়। বাবা ডেভিড ব্লেয়ার ছিলেন টাইটানিক জাহাজের সেকেন্ড অফিসার। জাহাজ তৈরির দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন তিনি। অবশেষে জাহাজ তৈরি হল। এবার শুধু সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া বাকি। ঠিক এমন সময়েই তাঁকে কাজ থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। না, এর আগে কোনো বড়ো জাহাজের নেতৃত্ব দেননি তিনি। এটাই ছিল তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ। অন্য একটি অলিম্পিক জাহাজ থেকে হেনরি ওয়াইল্ড নামে এক অফিসারকে নিয়ে আসা হয় তাঁর জায়গায়। ক্ষুব্ধ, অপমানিত ব্লেয়ার সমস্ত দায়িত্ব  হস্তান্তর করে বিদায় নিলেন।

সমস্যা হল, এই দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার সময় ক্রো’জ নেস্টের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন হেনরি ওয়াইল্ড। ডেভিড ব্লেয়ারও আর সে-কথা মনে পড়াননি। ন্যন্সি ব্লেয়ার অবশ্য বলেছিলেন, তিনি চাবির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে খেয়াল করেন তাঁর পকেটে চাবিটি থেকে গিয়েছে। অবশ্য তার আগেই ৩ এপ্রিল সাউথহ্যাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে টাইটানিক। তবে কেউ কেউ মনে করেন, অপমানের প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করেই চাবিটি নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছিলেন ডেভিড ব্লেয়ার। তবে এসবের সত্যতা আর জানা যাবে না কোনোদিন।

আরও পড়ুন
ইতিহাস বলে ‘গুজরাটের টাইটানিক’ নিখোঁজ হয়েছিল টাইটানিকেরও ২৪ বছর আগে

বাইনোকুলার থাকলেই যে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত, এমন কোনো নিশ্চয়তা অবশ্য ছিল না। হয়তো তারপরেও টাইটানিকের ডুবে যাওয়াই ভবিতব্য ছিল। তবে আগে থেকে হিমশৈলটিকে দেখতে পেলে দুর্ঘটনা এড়ানোর চেষ্টা তো করা যেত। ছোট্ট একটি চাবির জন্যই সেটা সম্ভব হল না। এই ঐতিহাসিক চাবি কিন্তু আপনিও দেখে আসতে পারেন চাইলে। ২০০৭ সালে চিনের এক জুয়েলারি ব্যবসায়ী ৯০ হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে কিনে নিয়েছেন সেই চাবি। আর নানজিং শহরে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় তা রাখা আছে। ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা যাওয়ার পথে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, তার চাবিকাঠি দেখতে আপনাকে যেতে হবে এই নানজিং শহরেই।

আরও পড়ুন
টাইটানিকের টেলিগ্রাফ যন্ত্র উদ্ধারের পরিকল্পনা গবেষকদের, কী ছিল শেষ বার্তা?

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সমুদ্রের নিচে এতগুলো বছর, কেমন আছে টাইটানিক?